
Home বিজ্ঞানী / Scientist > নীলরতন ধর / Nilratan Dhar (1892-1985)
এই পৃষ্ঠাটি মোট 99787 বার পড়া হয়েছে
নীলরতন ধর / Nilratan Dhar (1892-1985)
নীলরতন ধর
Nilratan Dhar
Home District: Jessore

প্রখ্যাত বিজ্ঞানী অধ্যাপক নীলরতন শিক্ষাজীবনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সর্বস্তরেই প্রথম। এম.এস.সি-তে কলা ও বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে সর্বোচ্চ রেকর্ড নম্বর পেয়ে কুড়িটি স্বর্ণপদক, গ্রিফিথ পুরস্কার ও এশিয়াটিক সোসাইটি প্রদত্ত পুরস্কার লাভ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন শাস্ত্রে এম.এস.সি পড়ার সময়ে বিজ্ঞান জগতের দুইজন দিকপাল আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র ও আচার্য জগদীশচন্দ্রের অধীনে গবেষণায় রত হন। ১৯১৫ সালে স্টেট স্কলারশিপ পেয়ে বিলেত যান। ১৯১৭ সালে লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবং ১৯১৯ সালে প্যারিসের সরবন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ডি.এস.সি’ উপাধি লাভ করেন। ১৯১৯ সালে লণ্ডনে ফিরে আই.ই.এস নির্বাচিত হয়ে এলাহাবাদ ম্যুর সেন্ট্রাল কলেজের রসায়ন বিভাগের প্রধান হিসেবে যোগ দেন। তাঁর গবেষণা জীবনের প্রথম কাজ ‘ইনডিউসড অ্যাণ্ড ফটো-কেমিক্যাল রিঅ্যাকশন’। শেষ জীবনেও তিনি নাইট্রোজেন ফিকশন নিয়ে গবেষণায় রত ছিলেন। তাঁর মৌলিক গবেষণাপত্রের সংখ্যা ছয়শতাধিক। ভৌত রসায়ন ক্ষেত্রে তিনি পথিকৃৎ হিসেবে স্বীকৃত। তিনি পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনারারি ডক্টরেট এবং এস এ হিল ও জি হিল স্মৃতি পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৩৮, ১৯৪৭ ও ১৯৫২ সালে তিনি নোবেল পুরস্কার কমিটিতে তিনি বিচারক ছিলেন। তিনি ভারতীয় বিজ্ঞান একাডেমীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৩৪ সালে ২০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে তাঁর নির্মিত ইণ্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব স্পেশাল সায়েন্স এর বাড়িটি তাঁর প্রথম স্ত্রী বিজ্ঞানী সেইলা ধরের মৃত্যুর পর (১৯৪৯) এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর নামাঙ্কিত করে। তিনি অত্যন্ত মিতব্যয় জীবনযাপন করতেন। গবেষণার জন্য তিনি বহু লক্ষ টাকা ব্যয় করেছেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে ৪ লক্ষ টাকা আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের নামে অধ্যাপক পদ ও ১ লক্ষ টাকা আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর নামে লেকচারার পদ সৃষ্টির জন্য দিয়েছেন। চিত্তরঞ্জন সেবাসদনকে ১ লক্ষ টাকা এবং ৭ বছরের সম্পূর্ণ বেতন তিনি এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করেন। ভারত সরকার তাঁকে “পদ্মশ্রী” খেতাব দিতে চাইলে তিনি তা বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলি হলোঃ
(১) আমাদের খাদ্য
(২) জমির উর্বরতা বৃদ্ধির উপায়
(৩) নিট কনসেপশন ইন বায়ো কেমিস্ট
(৪) ইনফ্লুয়েন্স অব লাইট ইন সাম বায়ো-কেমিক্যাল প্রসেস ইত্যাদি।
বিজ্ঞান জগতের এই দিকপাল মনীষী ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে ৫ ডিসেম্বর তাঁর কর্মময় জীবনের অবসান ঘটান।
----------------------------------------------------------------------------------------
নীলরতন সরকারের আদি নিবাস ছিল যশোহরে। কিন্তু তাঁর পিতা নন্দলাল পরে ২৪ পরগনার ডায়মণ্ড হারবারের নিকটবর্তী নেত্রাগ্রামে চলে আসেন। কিন্তু নদীর প্লাবনে তাঁদের বসতবাড়ি নদীগর্ভে অতলে চলে যায়। তখন তাঁদের পরিবার জয়নগরে চলে আসে। এই জয়নগরেই স্থানীয় বাংলা স্কুলে তিনি পড়াশোনা করে এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাস করেন ছাত্র নীলরতন সরকার। এরপর ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুল থেকে ডাক্তারিতে সার্টিফিকেট কোর্স করে সাব-অ্যাসিস্টেট সার্জেনের পদ পান। পড়াশোনার অদম্য স্পৃহায় তিনি স্কটিশ কলেজ থেকে এফ এ এবং পরে মেট্রোপলিটন কলেজ থেকে বি এ পাস করেন। নীলরতন সরকার ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের সহপাঠী। তাঁর জীবন শুরু থেকেই সংগ্রামের। কিছুকাল চাতরা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাজ নেন। কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞানে অনুরাগের জন্য তিনি ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়ে ১৮৮৮-তে কৃতিত্বের সঙ্গে এম বি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। সেই সময় প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ফিজিওলজিতে বি এ এবং এম এ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে পাস করেন। এর উপরে ১৮৯০ সালে এম ডি উপাধি লাভ করেন। তিনি কোন সরকারী চাকরি করেননি। অল্প সময়েই একজন নিপুণ চিকিৎসক রূপে দারুণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন ডাঃ নীলরতন সরকার। তাঁর অসামান্য যোগ্যতার জন্য ১৮৯০ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম তাঁকে ফেলো এবং পরে ফ্যাকাল্টি অব মেডিসিন এর ডিন হিসেবে মনোনীত করে। তাঁর স্বদেশ অনুরাগ ছিল প্রগাঢ়। ১৯১৬ খ্রীষ্টাব্দে রাধাগোবিন্দ কর এবং সুরেশপ্রসাদ সর্বাধিকারীর সঙ্গে একযোগে বেলগাছিয়া মেডিক্যাল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। যা পরে কারমাইকেল কলেজ এবং আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ নামে খ্যাত হয়। তাঁর বহুমুখী প্রতিভার জন্য ১৯১৯ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত তাঁকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য করা হয়। ১৯২০ সালে তাঁর ইমপিরিয়াল ইউনিভার্সিটি কমিশনে ভারতের প্রতিনিধত্ব করার সুযোগ হয়। এসময়েই তিনি লন্ডন যাত্রা করেন। তাঁর যোগ্যতার পরিচয় পেয়ে অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডিসি এল এবং ডি এল উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেন। দেশে ফিরে তিনি দেশহিতকর কাজে মনোনিবেশ করেন। যাদবপুর যক্ষা হাসপাতাল যা পরে কুমুদশঙ্কর রায়ের নামে নামান্বিত হয়। তাঁরই উদ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতীয় শিক্ষা পরিষদের সম্পাদক হিসাবে তিনি কারিগরি বিদ্যাপ্রসারে সচেষ্ট হন। তাঁরই প্রচেষ্টায় বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট, যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া ক্যালকাটা মেডিকেল ক্লাবের তিনি প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি প্রথম তাঁর চিকিৎসা বিজ্ঞানের উল্লেখ্যযোগ্য গবেষণা সিরোসিস অব লিভার ইন চিলড্রেন্স প্রকাশ করেন। এরজন্য তাঁকে মাতৃদুগ্ধ, গোদুগ্ধ এবং ছাগদুগ্ধের তুলনামূলক উপকারিতা-অপকারিতা নিয়ে গবেষণা করতে হয়। আবহাওয়ার ব্যতিক্রম বোঝার জন্য রোগীকে দার্জিলিঙের পাহাড়েও নিয়ে যেতে হয়। এটি একটি মূল্যবান গবেষণা। এমন এই রোগের প্রকোপ কমে গেলেও সে যুগের এই কারণে শিশুমৃত্যুর হার খুবই বেশি ছিল। ডাঃ সরকার খাদ্যখাবার এবং উপযুক্ত ওষুধ নিয়ে এই সমস্যার অনেকটাই সমাধান করেন। গবেষণাপত্রটি প্রথম ভারতীয় মেডিক্যাল কংগ্রেসের ট্রান্সাকশনে প্রকাশিত হয়। পরে ১৯৪৩ সনের জুন মাসের ক্যালকাটা মেডিক্যাল জার্নালে এটি আবার প্রকাশিত হয়। ডাঃ নীলরতন সরকার স্বদেশী শিল্পের দারুণ উদ্যোগী ছিলেন। তাঁর নিজস্ব প্রতিষ্ঠান ছিল ন্যাশনাল টানারি’। এছাড়া তিনি ন্যাশনাল সোপ কারখানার প্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন। রাঙামাটি চা কোম্পানী যা পরে ইস্টার্ন টি কোম্পানি নমে পরিচিত হয়। তাও তাঁর অর্থ বিনিয়োগে গঠিত হয়। ১৯০৮ সালে তিনি লুট অ্যান্ড ইমপ্রুভমেণ্ট কোম্পানীর ডিরেক্টর নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের অভিন্নহৃদয় সুহৃদ ছিলেন এবং আচার্য কার্তিক বসু এবং সত্যসুন্দর দেব স্বদেশী শিল্পের জোয়ার এনে দেন। বাংলার ছোটলাট লর্ড কারমাইকেলের দুরারোগ্য ব্যাধি সারিয়ে তোলার জন্য ব্রিটিশ সরকার তাঁকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি বসুবিজ্ঞান মন্দির, বিশ্বভারতী এবং ভারতীয় জাদুঘরের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ছিলেন। রাজনীতিতেও তাঁর অবদান কম নয়। ১৮৯০ সালে তিনি জাতীয় কংগ্রেসের যোগদান করেন এবং ১৯১৯ পর্যন্ত যুক্ত থাকেন। ওই সময় নরমপম্বীরা কংগ্রেস ত্যাগ করলে উনিও তাই করেন। ১৯১২-২৭ পর্যন্ত বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সংস্থার সদস্য ছিলেন। চিকিৎসক হিসেবে তিনি বিপুল অর্থ উপার্জন করেন। তাঁর বেশিটাই তিনি জনহিতকর কার্র্যে ব্যয় করেন। যেখানে ডাঃ সরকারের চিকিৎসাবিদ্যা শেখা সেই ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুল কলেচে রূপান্তরিত হলে তাঁরই নামে পরিচিত হয়। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় সবচেয়ে যশম্বী হন। সমস্ত রোগের মূল সম্পর্কে নীলরতন সরকারের বক্তব্য-
At the root of all evils lies our terrible ignorance-ig-norance of the origins nature symptoms and course of this disease. Ignorance of the method of treatment of this disease, ignorance of the measures to be adopted to check it spread.
এই বিষয়টি চূড়ান্ত করার জন্য নীলরতন তাঁর ৬১ নম্বর রোডের বাড়িতেই ক্লিনিক্যাল ল্যাবরেটরি তৈরি করেন। সেখানে সবরকমের রক্ত, মল, মূত্র, কফ এবং অন্যান্য দেহ-তরলের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হতো। তিনিই প্রথম তাঁর শর্ট ষ্ট্রিটের বাড়িতে বিদেশ থেকে কার্ডিওগ্রাফ মেশিন আনান। সেইসঙ্গে একাধিক অন্যান্য বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতিও আমদানি করেন। এইভাবে অত্যন্ত আধুনিক পদ্ধতিতে তিনি চিকিৎসা করতেন। ভালো ওষুধের প্রয়োজন বুঝে তিনি -এ প্রতিষ্ঠা করেন। আগে আমাদের দেশে সিরাম, ভ্যাকসিন এবং অন্যান্য জৈব উপাদান বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো। ১৯১৯ সালে ডাঃ কৈলাসচন্দ্র বসু এবং ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের সহযোগীতায় বেঙ্গল ইমিউনিটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে ২৫০ রকমের ওষুধ তৈরি হতো কলকাতায় ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ১২ বছর সম্পাদনা করেন। এই পত্রিকায় জনস্বাস্থ্যের সমস্ত দিক নিয়ে সবিস্তারে আলোচিত হতো। সর্বশেষে নীলরতন সরকার ছিলেন একজন উঁচুমানের গবেষক আর শিক্ষক। ১৮৯৪ সালে ২৭শে নভেম্বর ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স-এ জীববিদ্যা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হলে নীলরতন সরকার মহেন্দ্রলালের আহ্বানে দুবছর বায়োকেমিষ্ট্রি বিষয়ে একটানা ক্লাস নিয়ে যান। তিনি এবং ডাঃ রাধাগোবিন্দ কর এবং ডাঃ এস পি সর্বাধিকারী এঁরা সকলে মিলে একটি বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজ তৈরি করেছিলেন। পরে এর নাম হয় ক্যালকাটা মেডিক্যাল স্কুল। ১৮১৯ সালে এটি বেলগাছিতে স্থানান্তরিত হয়। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার ফলে ছোটলাট লর্ড কারমাইকেলের নামে এটিকে পরে কারমাইকেল মেডিক্যাল কলেজ হসপিটাল নামকরণ করা হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠাতা রাধাগোবিন্দ কর মারা গেলে কলেজটির নতুন নাম দেওয়া হয় জি কর মেডিক্যাল কলেজ। এখানে ভারীসংখ্যায় ভারতীয় ছাত্র চিকিৎসাবিজ্ঞানে ডিগ্রি নিতে আসতেন। কলেজের তৃতীয় সভাপতি ছিলেন ডাঃ নীলরতন সরকার। তিনি এই হাসপাতালের উন্নতিতে অনেক টাকা ব্যয় আর পরিশ্রম করেন। চিকিৎসাবিদ্যায় যেখানে হাতপাকানো সেই ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল কলেজের নাম ডাঃ নীলরতন সরকারের মৃত্যুর পর নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ নামে চিহ্নিত করা হয়। বাংলার ইতিহাসে এমন মানুষ যথেষ্ট দুর্লভ। এত বড় মাপের চিকিৎসক তবুও ডাঃ সরকারের কোন জীবনী লেখা হয়নি কোন ভাষায়।
তথ্যসূত্র: অজ্ঞাত
তথ্য সংগ্রহ:
মোঃ হাসানূজ্জামান বিপুল
হাবিবুর রহমান সাইমুম
শেষ আপডেট:
২৩.০৭.১২