
Home বিজ্ঞানী / Scientist > কে. পি. বসু / K. P. Boshu (1865-1914)
এই পৃষ্ঠাটি মোট 99898 বার পড়া হয়েছে
কে. পি. বসু / K. P. Boshu (1865-1914)
কে. পি. বসু
K. P. Boshu
Home District: Jhenaidah
পরিচিতি:
উপযুক্ত তথ্য ও উপাত্তের অভাবে কে. পি. বসুর জীবন ও সুকৃতির এমন যুক্তিসিদ্ধ পরিচয় তুলে ধরা যায় না যা বিচার বুদ্ধিসম্পন্ন পাঠকের অনুসন্ধিৎসা নিবৃত্ত করতে পারে। তাঁর জীবন স্মৃতি আচছন্ন অন্ধকারে নিমজ্জমান এবং যতদূর জানা যায় গণিত শাস্ত্র বিশেষতঃ তাঁর ঐকান্তিক সাধনার বিষয় এ্যালজাবরা বিষয়ে তাঁর অবদানও সংরক্ষিত নয়। তাই ঐতিহ্য সন্ধানী গবেষক, পাঠককে রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি বচনে আক্ষেপ করতে হয়:
“হে অতীত, তুমি ভূবনে ভূবনে
কাজ করে যাও গোপনে গোপনে।
মুখর দিনের চপলতা মাঝে
স্থির হয়ে কেন রও?
কথা কও, কথা কও।”

অতীতের পূঞ্জীভূত অন্ধকারে কে. পি. বসু আজ দূর আকাশের হৃত জ্যোতি নক্ষত্রের মতই অনুজ্জল, নিষপ্রভ। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিত্বের ঐশ্বর্য ও প্রতিভার ঔজ্বল্য একদিন সারা বাংলার আকাশকে করেছিল আলোকিত। বীজগণিতের ক্রমোন্নয়নে তিনি এক নতুন অধ্যায় সংযোজন করেছেন।
বাংলাদেশের এই বিখ্যাত গণিত শাস্ত্রবিদ অধ্যাপক কালিপদ বসু ইংরেজী ১৮৬৫ খৃষ্টাব্দে মোতাবেক ১২৭২ বাংলা সনে বর্তমান ঝিনাইদহ জেলার অন্তর্গত পতিহারি শংকরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা মহিমাচরণ বসু হরিশংকরপুর রেজিষ্ট্রি অফিসের (তৎকালীন ঝিনাইদহের রেজিষ্ট্রি অফিস হরিশংকরপুর গ্রামে অবস্থিত ছিল) একজন সামান্য ভেন্ডার ছিলেন। তাঁর একমাত্র পিতৃব্য চন্দ্র কুমার বসু গ্রাম্য কবিরাজ ছিলেন। জানা যায়, তাঁর পূর্ব পুরুষেরা বরিশাল থেকে হরিশংকরপুরে বসতি স্থাপন করেন।
কে. পি. বসুর দুই ভাই ছিলেন। প্রসন্ন কুমার বসু ও রাধিকা প্রসাদ বসু। কিন্তু তাঁর কোন বোন ছিল না। মেজ ভাই প্রসন্ন কুমার বসু (বিএ) তৎকালীন D.L.R- এর ব্যক্তিগত সচিব ছিলেন। তাঁর প্রতিভা ও কর্মদক্ষতার গুণে তিনি ‘রায় বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত হন। ছোট ভাই রাধিকা প্রসাদ বসু (M.A.B.L) যশোর জজ কোর্টের একজন খ্যাতনামা আইনজীবি ছিলেন। যশোর সম্মিলনী হাই স্কুলের পূর্ব প্রান্তে আজও তাঁর বসতবাটি বিদ্যমান। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তাঁর দুই পৌত্র দখলদার বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হন।
শিক্ষাজীবন:
গ্রাম্য পাঠশালার একজন মেধাবী শিক্ষক নছীম মন্ডলের কাছে কে. পি. বসু’র বাল্যশিক্ষা শুরু হয়। নছীম মন্ডল তাঁর এই প্রিয় শিষ্যকে অংক শাস্ত্রের জ্ঞান

কে. পি. বসু কলিকাতা বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন এই শিক্ষকের সাথে তাঁর যোগাযোগ অব্যাহত ছিল। নব উদ্ভাবিত অংকের আনন্দ তাঁর প্রিয় ছাত্রের সাথে ভাগ করে নেওয়ার জন্যে তিনি প্রায়শঃই কলকাতা যেতেন। একদিনের ঘটনা, নছীম মন্ডল কলকাতা এসেছেন। সাথে এনেছেন এক বিশাল অংক। উদ্দেশ্য তাঁর ছাত্রের জ্ঞান পরীক্ষা। বাসায় এসে যখন পৌঁছলেন, কে পি বসু তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর তাঁর মাথায় এক বুদ্ধি খেলে গেল। কয়লা দিয়ে বাসার দেওয়ালে এঁকে রাখলেন অংকের আলপনা। তারপর অন্য কাজে নিষ্ক্রান্ত হলেন। বাসায় ফিরে কে. পি. বসুর দৃষ্টি নিবন্ধ হল অংকের দিকে। দেওয়ালের লিখন তিনি পাঠ করলেন। তারপর শুরু করলেন অংকের সমাধান। ইতোমধ্যে দৃশ্যপটে উপস্থিত হলেন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক। কিছুটা অলক্ষ্যে থেকে তিনি লক্ষ্য করতে লাগলেন তার শিষ্যের সযত্ন প্রয়াস। মুখে তাঁর স্মিত হাসি, চোখে কৌতুহল আর বুকের মধ্যে দৃঢ় আত্নপ্রত্যয়। এক সময় অংক মিলে গেল। বিজয়ীর হাসি হাসলেন কে. পি. বসু। তারপর পিছনে ফিরে তাকালেন। গুরু শিষ্যের চোখাচোখি হল। কি এক অদ্ভুদ বিহ্বল দৃশ্য! উভয়েই নির্বাক চেয়ে রইলেন পরস্পরের দিকে। তার স্বস্তি ফিরে পেলেন কে. পি. বসু। ছুটে এসে ষাষ্টাংগে প্রণাম জানালেন তার শিক্ষককে। গর্বে ভরে উঠলো শিক্ষকের বুক। আবেগ রুদ্ধ ভাষায় তিনি তাঁর শিষ্যকে প্রাণভরে আশির্বাদ করলেন।
কে. পি. বসুর মানস গঠনে তথা অংক শাস্ত্রে তাঁর আজীবনের কৌতুহল উৎসারণে গ্রাম্য পাঠশালার এই অখ্যাত শিক্ষকের ভূমিকা অপরিসীম।
পেশাগত জীবন:
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে কে. পি. বসু সম্ভাবতঃ ১৮৯২ সালের দিকে ঢাকা কলেজে গণিতের শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন এবং আমৃত্যু উক্ত

গনিত শাস্ত্রে বসুর অবদান:
আরবীয় বীজগণিত ত্রয়োদশ শতকে ইউরোপে বিশেষতঃ ইটালীতে প্রবর্তিত (Introduced) হয়। আধুনিক এ্যালজাবরা ইউরোপীয় শাসনামলে ভারতবর্ষে আমদানী হয় এবং যতদূর জানা যায়, হান্টার কমিশন (১৮৮২) এর সুপারিশক্রমে তা ভারতীয় শিক্ষাসূচীর অনত্মর্ভূক্ত হয়। এ্যালজাবরা, এমনকি ইউরোপীয় সংস্কার সত্ত্বেও ভারতীয় শিক্ষার্থীদের কাছে ছিল অত্যন্ত দুর্বোধ্য। কে. পি. বসু এই দুরূহ শাস্ত্রের অধ্যয়ন ও অনুশীলনকে অনায়াস ও সহজসাধ্য করেছেন। এ প্রসংগে দীর্ঘদিনের শ্রমসাধ্য গবেষণায় তিনি এ্যালজাবরার বহু বিচিত্র ও জটিল নিয়মকে সহজ প্রণালীতে সূত্রবদ্ধ করেন। বর্তমানে প্রচলিত বহু সূত্র কে. পি. বসুর উদ্ভাবিত। শুধু সূত্র আবিষ্কারই নয় অসংখ্য নতুন অংক উদ্ভাবন করেও তিনি এই শাস্ত্রের কলেবর বৃদ্ধি ও উৎকর্ষ সাধন করেছেন।
এসবই কেবল কে. পি. বসুর অবদানের সাধারনী কৃতরূপ। বিজ্ঞ পাঠকের যুক্তিসিদ্ধ কৌতুহল এমন সরল সিদ্ধান্তে নিবৃত্ত হতে পারে না। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে গবেষণা কর্মে প্রয়োজনীয় তথ্য ও উপাত্ত বাংলাদেশে নিতান্তই বিরল। তাছাড়া সময়ের অপ্রতুলতা হেতু তাঁর আজন্মের কর্ম ও সাধনা ক্ষেত্র ঢাকা কলেজ ও তাঁর বর্তমান প্রজন্মের স্থায়ী বাসস্থান কলকাতায় যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। আবার কে. পি. বসুর এ্যালজাবরা এখন ইতিহাসের অনুষংগ। আধুনিক গণিতজ্ঞরা তাঁর সন্বন্ধে অজ্ঞ ও নিষ্পৃহ। তবে আশা করা যায় যে, কলকাতায় তাঁর যে বংশধর রয়েছেন, তাঁরা তাঁর স্মৃতি ও সুকৃতিতে কিছুটা হলেও সংরক্ষণ করেছেন। (পরবর্তীতে এ বিষয়ে বিশদ আলোচনার ইচ্ছে রইল)।
গনিত শাস্ত্রের ইতিহাস:
গণিত শাস্ত্রের ইতিহাস সুপ্রাচীন ব্যাবলনীয় সভ্যতার সাথে সম্পর্কযুক্ত। এশিয়া মাইনর ও ব্যাবলনীয় সংস্কৃতি গ্রীক সভ্যতাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল এবং এটা নিশ্চিত যে গ্রীক জাতি এই উৎস থেকে বীজগণিতের অনেক মৌলিক জ্ঞান আহরণ করেছিল।
আয়োনীয় (প্রাচীন গ্রীস) বণিকগণ বাণিজ্য ব্যাপদেশে এই সুপ্রাচীন ও অত্যন্ত সম্মানিত ব্যাবলনীয় কৃষ্টির সাথে পরিচিত হয় ও সেখান থেকে গণিত, জ্যামিতি, জ্যোতিষ শাস্ত্র, প্রকৃতি বিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞান প্রভৃতি শিক্ষাগ্রহণ করে মেধাবী ছাত্রগণের মাধ্যমে তা বিশ্বময় প্রচারিত করেছিল।
এই ভাব বিনিময়ের দ্বিতীয় ফল হল গ্রীক দর্শনের সর্বপ্রাচীন শাখা আয়োনীয় সমপ্রদায় (আলেক্স, এ্যানাক্সিমিন, এ্যানাক্সিসেন্ডার প্রমুখ) এর আবির্ভাব। এই আয়োনীয় দার্শনিকগণই পাশ্চাত্য দর্শনকে বিকশিত করার প্রথম প্রয়াস করেছিলেন।
প্রাচ্যে- ভারত, চীন ও জাপানে বীজ গণিতের ক্রমন্নোয়ন বিষয়ে বহু বিসম্বাদ রয়েছে। এই বিসম্বাদ অংশও আবার জাতীয়তার গন্ধ মাখান। এসব দেশের বীজগণিত ব্যাবিলনীয় ও খ্রীস্টীয় পন্ডিতদের দ্বারা প্রভাবিত বলে মনে হয়।
হিন্দু বীজ গাণিতিকদের মধ্যে দু’জনের নাম সর্বিশেষ উল্লেখযোগ্যঃ ব্রহ্মগুপ্ত (৬৩০ খৃঃ) ও ভাস্কর (১১৫০ খৃঃ) ব্রহ্ম গুপ্ত উদ্ভাবিত অনির্দিষ্ট সমীকরণ অনেকাংশে গ্রীক পন্ডিত দিয়া- ফ্যানটাস (Diaphantus) কে ছাড়িয়ে গেছে। ভাস্কর রচিত ‘লীলাবতী’ ও ‘বীজগণিত’ ভারতীয় বীজগণিতের ইতিহাসে দু’টি মাইল ফলক।
ইসলাম ধর্মের অভ্যুদয়ের সাথে সাথে আরব বিশ্ব গণিত শাস্ত্র অধ্যয়ন ও অনুশীলনের কেন্দ্রে পরিণত হয়। অনেক অংক শাস্ত্রবিদ গ্রীক জ্যামিতি শাস্ত্রের উপর টীকাভাষ্য রচনা করেন। বীজগণিতের তাদের মৌলিক অবদান অসামান্য।
আলমাহানী (৮৫০ খৃঃ), তাবিত ইবনে কোরা (৮৭০ খৃঃ), আলহাচ্ছেন (১০০০ খৃঃ) এবং সর্বোপরি কবি ও গাণিতিক ওমর খৈয়াম (১১০০ খৃঃ) গভীরভাবে এই শাস্ত্র কর্ষণ করেছিলেন। ঘন ফলের সমীকরণ ছিল এ সকল লেখকের প্রিয় বিষয়। সুতরাং বীজগণিত একটি বহুজাতিক সৃষ্টি।
ব্যক্তিগত জীবন:
উপযুক্ত বয়সে কে. পি. বসু স্বগ্রামের অনিন্দ্য সুন্দরী সেখমালা ঘোষকে বিয়ে করেন। সেখমালা ঘোষের পিতা তারেকা চন্দ্র ঘোষ হরিশংকরপুরের তৎকালীন অপুত্রক জমিদারের ঘরজামাই ছিলেন। কে. পি. বসুর একমাত্র শ্যালক অতুল্য ঘোষ প্রথম কংগ্রেস সরকারের একজন মন্ত্রী। জানা যায়, বিয়ের পর প্রথম ‘ফিরেনী যাত্রায়’ শ্বশুর মেয়ে জামাইকে আনার জন্য ১৬ বেহারার পালকী পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু কে. পি. বসু স্ত্রীকে পালকীতে চড়িয়ে নিজে হেঁটে শ্বশুর বাড়ীতে গিয়েছিলেন।
কে. পি. বসুর তিন সন্তান। দুই পুত্র, এক কন্যা। জ্যৈষ্ঠ পুত্র জিতেন্দ্র কুমার বসু ১৯৮০ সনে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। দ্বিতীয় পুত্র ত্রিদিবেশ বসু (দেবু)’র মৃত্যু হয় ১৯৮৩ সালে। কন্যা ভেন্দা’র অকাল মৃত্যু হয়। ত্রিদিবেশ বসুর একমাত্র কন্যা সান্তা বসু চিরকুমারী ও আজীবন শিক্ষাব্রতী। দেশী ও বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতটি ডিগ্রী অর্জন করে তিনি এখন ভারত সরকারের শিক্ষা বিভাগের উচ্চপদে অধিষ্ঠিতা ছিলেন। তাঁর পুত্র জয়ন্ত বসু কে. পি. পাবলিশিং কোম্পানীর বর্তমান স্বত্বাধিকারী
ব্যক্তিগত জীবনে কে. পি. বসু অত্যন্ত সদালাপী, অমায়িক ও অনাড়াম্বর ছিলেন। বদান্যতা ও দানশীলতায়ও তিনি কম যেতেন না। ঢাকা কলেজ, তাঁর কর্মক্ষেত্র থেকে তিনি বছরে দুইবার গ্রামের বাড়ীতে আসতেন। দুর্গা পূজা ও বড়দিনের ছুটিতে। তখন তিনি গ্রামের দরিদ্র জনসাধারণকে ব্যাপকভাবে অন্নবস্ত্র ও অর্থ বিতরণ করতেন।
বাংলা ১৩১৩ সাল থেকে তাঁর বাড়ীর বিশাল পূজা মন্ডপে দুর্গা ও কালি পূজা শুরু হয়। তাঁর পৈতৃক গুরুদেব যশোর জেলার মল্লিকপুর নিবাসী হৃষিকেশ ভট্টাচার্য এই পূজায় পৌরহিত্য করতেন। আর ভাড়ার রক্ষকের দায়িত্বে থাকতেন হরিশংকরপুর সন্নিহিত লৌহজং গ্রামের যজ্ঞেশ্বর কুন্ডু। নীরস গণিত শাস্ত্রের অধ্যাপনা করলেও কে. পি. বসু সংগীত ও নাট্যামোদী ছিলেন। শারদীয় দুর্গোৎসবের সময় তাঁর মন্ডপ প্রাঙ্গনে নিয়মিত সংগীত ও যাত্রানুষ্ঠান হত। তিনি সাধারণ দর্শকদরে মাঝে বসে তা উপভোগ করতেন।
কে. পি. বসুর স্মৃতি:
আপন মেধা, অধ্যবসায় ও পরিশ্রমের বলে তিনি তাঁর পিতৃ পুরুষের দৈন্যদশা থেকে প্রভূত প্রতিষ্ঠা ও অর্থের অধিকারী হয়েছিলেন। ১৯০৭ খৃষ্টাব্দে তিনি এক একর জমির উপর এক বিশাল দ্বিতল ভবন নির্মাণ করেন। ছয় কক্ষবিশিষ্ট একটি রান্নাঘরসহ এই প্রাসাদোপম ভবনটি মোট ১৭টি কক্ষে বিভক্ত। নিরামিষ ও আমিষ রান্নার জন্যে তাঁর বাড়ীতে আলাদা ব্যবস্থা ছিল এবং ভাড়াটিয়া ব্রাহ্মণ রান্নার কাজে নিযুক্ত ছিল। বাড়ীর মোট ৪০ জোড়া দরজা, জানালা ও অন্যান্য আসবাবপত্র নির্মাণের জন্য বার্মা থেকে সেগুন কাঠ আমদানী করা হয়।
বাড়ীর নিম্নবাহিনী নবগংগা নদীতে তিনি বাঁধান ঘাট নির্মাণ করেন। বাড়ী থেকে ঘাট পর্যন্ত প্রায় ২৫০ মিটার সুরকী বিছান পথের ভগ্নাবশেষ আজও বিদ্যমান। কালের গ্রাস থেকে কে এগুলি রক্ষা করবে?
পরলোগ গমন:
কে. পি. বসুর প্রতিভা যখন তাঁর সৃষ্টি সাধনার মধ্যাহ্ন গগনে, তাঁর ক্ষুরধার লেখনী তখনই সর্বগ্রাসী মৃত্যু তাকে ছিনিয়ে নিল তাঁর ঐকান্তিক সাধন ক্ষেত্র থেকে। ১৯১৪ সালে ভয়ংকর পার্নিসাস ম্যালেরিয়া জ্বরে মাত্র তিন দিনের রোগ শয্যায় এই মহান গণিতজ্ঞের জীবনাবসান হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত শাস্ত্রের পরীক্ষক অধ্যাপক কে পি বসুর শয্যা পরে তখনও স্তুপীকৃত ছিল পরীক্ষার অসংখ্য উত্তরপত্র। নিষ্পন্দ অধ্যাপকের পাশাপাশি এই স্তুপীকৃত অংকরাশি যেন তাঁর জীবনেরই মহিমান্বিত রূপ। মাত্র ৫১ বছর বয়সে এই মনীষীর মৃত্যুতে বাঙ্গালী জাতি এক শ্রেষ্ঠ সন্তানকে হারাল। আঞ্চলিকভাবে যাঁর শূন্য স্থান পূরণ করা আজও সম্ভব হয়নি। শোনা যায়, কে পি বসুর মৃত্যু সংবাদ প্রচারিত হবার সাথে সাথে দূর-দূরান্ত থেকে অসংখ্য মানুষের সমাবেশ ঘটে তাঁর শেষ শয্যা পাশে। অসংখ্য ফুলে ও অজস্র চোখের জলে তারা তাদের মহান গণিতজ্ঞের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করে। কলকাতার নিমতলা শ্মশানে তাঁর শেষ কৃত্য সম্পন্ন হয়।
তাঁর বাক্স বন্দী মৃতদেহ যখন নৌকাযোগে ঝিনাইদহ শহরে আনা হয় তখন সেখানে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যে অবতারণা হয়। ঝিনাইদহের সকল অফিস আদালত একে একে বন্ধ হয়ে যায়। অসংখ্য মানুষের ভীড়ে নদী তীর হয়ে ওঠে লোকারণ্য। রাশি রাশি পুষ্প বৃষ্টিতে নৌকা গর্ভ হয় পরিপূর্ণ। জনগণ তাঁর মৃতদেহ বহন করতে এত উৎসাহী হয়ে ওঠে যে মৃত দেহের বাক্স স্পর্শ করার স্থানাভাবে তারা সম্পূর্ণ নৌকাটিকেই J.J.R. Railway Station- এ বহনে উদ্যত হয়। কিন্তু নৌকার মাঝির ঐকান্তিক আপত্তির কারণে তারা সে পরিকল্পনা ত্যাগ করে। ঝিনাইদহ থেকে চুয়াডাঙ্গা হয়ে তাঁর মৃতদেহ কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নিমতলার শ্মশানে অসংখ্য গুণগ্রাহী ও শোকাকুল মানুষের সমাবেশে পবিত্র আগুনে তাঁর শবদেহ আহূতি দেওয়া হয়। ঝিনাইদহের যে রাসত্মা দিয়ে তাঁর মৃতদেহ বহন করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সেটিই এখন কে. পি. বসুর সড়ক নামে পরিচিত।
শেষ কথা:
বহমান নবগংগার স্থলে কে. পি. বসুর কৈশোর ও যৌবন ভেসে গেছে। শুধু নদী তীরের বয়সী বট ও কালের সাক্ষী কাঠ বাদামের গাছ কে. পি. বসুর স্মৃতি চিহ্নকে বক্ষে ধারণ করে আজও ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। আর আছে শতাব্দী পুরাতন এক বৃদ্ধ সন্ন্যাসী চরণ বিশ্বাস। যিনি এই মহান গণিতজ্ঞের সান্নিধ্যে ধন্য। তাঁর জীবনের নানা রং এর দিনগুলো, এমনকি শ্মশানে তাঁর চিতাভস্ম এই বৃদ্ধের মনের মধ্যে প্রসারিত হয়ে আছে। কিন্তু জীবন সায়াহ্নে তিনিও আজ স্মৃতিভ্রষ্ট নির্বাক।
কে. পি. বসু তাঁর স্বল্পকালীন জীবনে প্রতিভা ও সাধনার বলে আমাদের জন্য এক অক্ষয় কৃতি রেখে গেছেন। ঐতিহ্যের মহিমায় তাঁর অমূল্য মনীষা চিরদিন আমাদের উদ্বুদ্ধ করবে। তাঁর সহপাঠী বাংলার বাঘ আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ও বিখ্যাত গণিতজ্ঞ দেব প্রসাদ ঘোষের মতই তিনি আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল। তাঁর মহান স্মৃতিকে সযত্নে সংরক্ষণের মাধ্যমে আমরা আমাদের আতস বিস্মৃতির অপবাদ কিছুটা হলেও ঘুচাতে পারি।
তথ্য সূত্র:
ঝিনাইদহের ইতিহাস
লেখক: মির্জা মোহাম্মদ আল-ফারূক
সম্পাদনা:
মো: হাসানূজ্জামান (বিপুল)
সর্বশেষ আপডেট:
অক্টোবর ২০১১