
Home রাজনীতিবিদ / Politicians > খান টিপু সুলতান / Khan Tipu Sultan (1950)
এই পৃষ্ঠাটি মোট 91548 বার পড়া হয়েছে
খান টিপু সুলতান / Khan Tipu Sultan (1950)

খান টিপু সুলতান; একজন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ। ১৯৫০ সালের ১৩ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন তিনি। খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার ধামালিয়ার জমিদার বাড়ী অর্থাৎ মামার বাড়ীতে তাঁর জন্ম। দাদার বাড়ী নড়াইল জেলার নড়াইল থানার চন্ডিবরপুর ইউনিয়নের গোয়াল বাতান গ্রামে। পিতা আব্দুল হামিদ খান পেশাগতভাবে তালুকদার ছিলেন। মা আনজীবন আরা বেগম ছিলেন গৃহিণী। দাদা ছিলেন বৃটিশ শাসনামলে যশোর জেলার অনারারি ম্যজিস্ট্রেট। পরবর্তীতে তিনি পিভি কাউন্সিলের মেম্বার হয়েছিলেন। ছোট বেলায় দাদা-দাদীর মৃত্যুর কারণে তাঁর পিতা নানা বাড়ীতে বড় হয়েছিলেন এবং সেখানেই বসতি স্থাপন করেন। টিপু সুলতান তিন ভাই ও চার বোনের মধ্যে ৫ম এবং ভাইদের মধ্যে দ্বিতীয়। বড় ভাই ছিলেন সাংবাদিক। ছোট ভাইও রাজনীতিবিদ। খুলনায় সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত তিনি।
১৯৮২ সালের ১৭ অক্টোবর খুলনার মেয়ে জেসমিন আরা বেগমকে বিয়ে করেন তিনি। বর্তমানে তার স্ত্রী একটি প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজের গাইনী বিভাগের প্রধান হিসেবে কর্মরত আছেন। পারিবারিকজীবনে তিনি দুই পুত্র সনত্মানের জনক। বড় ছেলে হুমায়ুম সুলতান (সাদাব) এল. এল. বি অনার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র আর ছোট ছেলে জুবায়ের সুলতান (পেলব) এ লেভেলে পড়াশুনা করছে।
শিক্ষাজীবন:
শিক্ষাজীবন শুরম্ন হয় ১৯৫৬ সালে; ডুমুরিয়ার রঘুনাথপুর গ্রামের পাঠশালাতে। দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়াকালীন বাবা ক্যান্সারে মারা গেলে টিপু সুলতান অভিভাবকহীন হয়ে পড়েন। এসময় লেখাপড়ার জন্য তাঁকে যশোরের লোনঅফিস পাড়ায় মামা বাড়ী চলে আসতে হয়। ১৯৬৪ সালে যশোর সম্মিলনী স্কুলে ৮ম শ্রেণীতে ভর্তি হন তিনি। ১৯৬৭ সালে এই স্কুল হতে এস. এস. সি পাশ করেন। পরে ভর্তি হন যশোর সরকারী এম.এম কলেজে। বিষয় হিসেবে বেছে নেন বাণিজ্য বিভাগ। আইয়ুব-মোনায়েম শাসন আমলে সক্রিয়ভাবে তিনি ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এই অপরাধে কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁকে ১৯৬৮ সালে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নিলে, তিনি ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নিয়ে চলে যান নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজে। ১৯৬৯ সালে তিনি এইচ. এস. সি. পাস করেন। পরে আবার যশোর সরকারী এম. এম. কলেজে ফিরে গিয়ে বি.কম-এ ভর্তি হন। ডিগ্রীতে পড়াকালীন দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে তিনি যুদ্ধে চলে যান। যুদ্ধ পরবর্তীকালে ১৯৭২ সালে একই কলেজ থেকে বি. কম. পাস করেন।
১৯৭২ সালে তার উদ্যোগে যশোরে শহীদ মশিয়ুর রহমানের নামে একটি ল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে নিজের প্রতিষ্ঠা করা ল কলেজে পড়াশুনা শুরম্ন করেন। ল কলেজের ছাত্র হিসেবে টিপু সুলতান প্রথমবর্ষ সম্পন্ন করেন। এরপর রাজনীতিতে এতোটাই ওতপ্রেতভাবে জড়িয়ে পড়েন যে, শেষ পর্যন্ত তাঁর আর ফাইনাল পরীক্ষা দেয়া হয়ে ওঠেনি।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ করার অপরাধে সামরিক সরকারের হাতে গ্রেফতার হন এই বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার হয় তার ঠিকানা। এখানেই কাটে তাঁর বন্দীজীবন। কারাগারে বন্দী অবস্থায় ১৯৭৬ সালে এল. এল. বি ফাইনাল পরীক্ষার জন্য আবেদন করেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১৯৭৭ সালে ল সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ নেয়ার অনুমতি দেয়। পরীক্ষার আগের দিন তাঁকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে স্থানানত্মর করা হয় যশোর কারাগারে। এই কারাগারে বসে পরীক্ষা দিয়ে তিনি এল. এল. বি পাস করেন। ১৯৭৭ সালের আক্টোবরে তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান। ১৯৭৮ সালে বার কাউন্সিল পরীক্ষায় অংশ নিয়ে অ্যাডভোকেটশীপ অর্জন করেন এবং আইন পেশায় যোগ দেন। বার কাউন্সিল হতে হাইকোর্ট ডিভিশনে প্রাকটিস করার জন্য তিনি ১৯৮৫ সালে সনদ পান।
কর্মজীবন:
খান টিপু সুলতান ১৯৭২ সালে যশোর থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বিল্পব নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। সম্পাদনার দায়িত্ব নেন নিজেই। ১৯৭৫ সালে জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠাকালে সাপ্তাহিক বিপস্নব বন্ধ হয়ে যায়। টিপু সুলতানের কারামুক্তির পর তৎকালীন জিয়া সরকারের কাছে সাপ্তাহিকটি পুন:প্রকাশের আবেদন করেন। কিন্তু সামরিক সরকার অনুমতি দেয়নি। পরে সাংবাদিকতা পেশা ত্যাগ করে তিনি পুরোপুরি আইন পেশায় নিয়োজিত হন।
১৯৮৯ সালে টিপু সুলতান যাশোর জেলা বার এ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি যশোর বারের সম্পাদক থাকা অবস্থায় ঐ বছরেই অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দিতা করেন। ঐ নির্বাচনে টিপু সুলতানের প্রতিদ্বন্দী হিসেবে যিনি বিজয়ী হয়েছিলেন ১৯৯০ সালে তার আকষ্মিক মৃত্যুর কারণে খান টিপু সুলতানকে বার কাউন্সিলের নির্বাচিত সদস্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরে তিনি ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত দক্ষতার সাথে বার কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করে সুনাম অর্জন করেন। ১৯৯৫ সালে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দিতা করেন তিনি। এবার বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করেন তিনি। বার কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে তিনি অর্থ বিষয়ক কমিটি এবং একই সঙ্গে বার কাউন্সিল ট্রাইব্যুনালের সদস্য হিসেবে কাজ করে সফলতা অর্জন করেন। বর্তমানে তিনি আইন পেশায় নিয়োজিত আছেন। ছুটির দিনে তিনি চলে যান গ্রামে। এ সময় তিনি কাজ করেন নিজের কৃষি খামারে।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ:
১৯৬৯ সালের ছাত্র-গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দেন টিপু সুলতান। এই আন্দোলনের শুরম্নতে যশোরের এম. এম. কলেজ থেকে তার নেতৃত্বে প্রথম মিছিল বের হয়। এসময় তিনি যশোরের ছাত্র সমাজের কাছে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। শুধু ছাত্র সমাজে নয় পুরো যশোরে অনেক জনপ্রিয়তা লাভ করেন। ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনের পর পর যশোর জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং ওই সম্মেলনে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন খান টিপু সুলতান। এ সময়ে আইয়ুব খানের পতন এবং ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতা গ্রহণের পর জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা আসে। এর কিছুদিন পর যশোরে মুসলিম লীগের নেতা নূরুল আমিনের আগমন নিয়ে গণপ্রতিরোধ সৃষ্টি করেছিলেন। এ ঘটনায় খান টিপু সুলতানসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে সামরিক আদালতে মামলা হয়। বিচারে তাঁদের ৬ মাসের কারাদন্ড হয়। তিনি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে গ্রেফতার এড়িয়ে ’৭০-এর নির্বাচনী প্রচারণার জন্য চট্টগ্রাম ও খুলনার বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থান করেন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ব্যাপক বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঢাকায় পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বৈঠক হয়। বৈঠকে খান টিপু সুলতানসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহার করতে বঙ্গবন্ধু অনুরোধ করেন ইয়াহিয়া খানকে। এর প্রেক্ষিতে মামলা প্রত্যাহার হয়।
১৯৭১ সালের প্রথম দিকে যশোর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি হিসেবে ছাত্র সমাজকে সংগঠিত করে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তারা সশস্ত্র লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি নেন। এসময় এক বিশেষ মুহুর্তে তাদের মিছিলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গুলি চালায়। ৩ মার্চের সেই মিছিলে যশোরে প্রথম শহীদ হন চারম্নবালা। চারুবালা যখন গুলিবিদ্ধ হন টিপু সুলতান ছিলেন তার পাশেই। চারুবালার মরদেহ নিয়ে রাজপথে সেদিন মিছিল করেছিল ছাত্র সমাজ। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ নিয়াজ পার্ক হিসেবে পরিচিত কালেক্টরেট ময়দানে মঞ্চ তৈরি করে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা পতাকা উত্তোলন করেন টিপু সুলতান ও তাঁর রাজনৈতিক সহযোদ্ধারা। এ সময় তিনি সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর অভিবাদন গ্রহণ করেন। সে দূর্লভ মুহূর্তের ছবি এখনও যশোর ইনস্টিটিউট পাবলিক লাইব্রেরি ও যশোর সেনানিবাসের জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাক সেনাবাহিনী যখন সশস্ত্র হামলা চালায় তখন খান টিপু সুলতান ছিলেন এম. এম কলেজের বর্তমান পুরাতন হোস্টেলে। সে সময় ছাত্র-জনতাকে নিয়ে তারা ক্যান্টনমেন্ট সংলগ্ন আরবপুর মোড়ে ব্যারিকেড দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। পাক সেনাদের গতিরোধ করার জন্য যে বোমা হামলা চালানো হয় তার নেতৃত্ব ছিলেন খান টিপু সুলতান। প্রথম দফা ব্যর্থ হয়ে রাত্র ১টার দিকে পাক সেনাবাহিনী আবার শহরে প্রবেশ করে। তারা এম. এম. কলেজের হোস্টেলে ব্যাপক তল্লাসী চালায়। খান টিপু সুলতানকে খোঁজাখুজি করে না পেয়ে বই ও আসবাবপত্র নিয়ে যায়। খান টিপু সুলতান ঐ রাতে হোস্টেলে অবস্থান না করায় প্রাণে বেঁচে যান। পরদিন ২৬ মার্চ সকাল থেকে পাক সেনাবাহিনী খান টিপু সুলতানকে ধরিয়ে দিতে ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে; মাইকে ঘোষণা দেয়। তাঁকে বার বার আত্নসমর্পণের জন্য বলা হলেও টিপু সুলতান শহরের কাজী পাড়ায় মিঞা মতিনের বাড়ীতে আত্মগোপন করে থাকেন। সেখানে দু’দিন অবস্থানের পর ২৭ মার্চ চলে যান হাসান শিবলীর বাড়িতে। এই অবস্থায় বঙ্গবন্ধু ও রাজনৈতিক সহপাঠিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রতিরোধ সংগ্রামের মানসিক প্রস্তুতি জোরদার করেন। ৩০ মার্চ ইপিআর ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে যুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনী পরাজিত হলে শহর মুক্ত হয়। এ সময় খান টিপু সুলতানের নেতৃত্বের মিছিল বের হয় এবং কন্ঠ শিল্পী শাহ মোঃ মোরশেদ রাজপথে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করেন।
পরে পাক হানাদার বাহিনী আবার শহরে প্রবেশ করলে তিনি যশোর শহর ছেড়ে নড়াইলে অবস্থান নেন। এর দু’দিন পর তিনি বাঘারপাড়া, ডুমুরিয়া ও মনিরামপুরে আত্নগোপন করে সাংগঠনিক কাজ করেন। হানাদারদের আক্রমণের এক পর্যায়ে ইপিআর সদস্যরা ছত্রভঙ্গ হলে টিপু সুলতান ভারত যান মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে। জেনারেল ওসমানীর সঙ্গে যোগাযোগ হলে তাঁর নির্দেশ ও নেতৃত্বে বাংলাদেশের নেতৃস্থানীয় ছাত্রদের নিয়ে একটি স্পেশাল অপারেশান গ্রুপ গঠন করে তাদের নিয়ে বিহারের চাকুলিয়াতে সশস্ত্র ট্রেনিং নেন তিনি। সেখানে ট্রেনিং শেষে ফিরে আসেন দেশে। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার তাকে যশোর সেক্টরে স্টুডেন্ট পলিটিক্যাল লিয়াজোঁ অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেন। তৎকালীন সেক্টর কমান্ডার মেজর ওসমান তাঁকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন। তিনি যশোর সেক্টরে গেরিলা যোদ্ধাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়ে অগ্রসর করার দায়িত্ব পালন করেন। প্রত্যেকটি অপারেশন ক্যাম্পে গিয়ে তাদের সংগঠিত করেন এবং প্রশিক্ষণ দেন। তার পরামর্শে বিভিন্ন মহকুমা ও থানায় এফ. এফ কমান্ডার নিয়োগ দেন সাব-সেক্টর কমান্ডাররা।
চৌগাছায় জাহাঙ্গীরপুর গ্রামে এসে সশস্ত্র সহযোদ্ধাদের নিয়ে অবস্থান গ্রহণ করেন এবং চৌগাছার সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন খান টিপু সুলতান। এ যুদ্ধ হয়েছিল চৌগাছা থানার বেশিরভাগ এলাকা জুড়ে। দু’পক্ষই এ যুদ্ধে ট্যাংক ব্যবহার করে। মিত্র বাহিনী যুক্ত হওয়ায় এটি ভয়াবহ যুদ্ধে রূপ নেয়। অবশেষে হানাদাররা টিকতে না পেরে অনেক ক্ষয়ক্ষতির পর ৩ ডিসেম্বর পিছু হঠতে বাধ্য হয়। ৭ ডিসেম্বর যশোর মুক্ত হয়। ১৬ ডিসেম্বর আসে চূড়ান্ত বিজয়।
বর্তমানে খান টিপু সুলতান মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
রাজনৈতিক জীবন:
১৯৬৬ সালে যশোর সম্মিলনী স্কুলে ১০ম শ্রেণীতে পড়াকালীন তিনি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। এসময় তিনি অনেক ছাত্রকে ছাত্রলীগের সদস্য করেন এবং ছাত্রলীগকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করেন। এতে জেলা ছাত্রলীগের নেতারা খুশি হয়ে ঐ সময়েই তাঁকে যশোর শহর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেন। ১৯৬৭ সালে যশোর জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পারিবারিক কারণে চট্টগ্রামে চলে গেলে দায়িত্ব দেয়া হয় টিপু সুলতানকেই। ১৯৬৮ সালে ছাত্রলীগের সম্মেলনের মাধ্যমে যশোর জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি পুনঃনির্বাচিত হন তিনি। ১৯৬৯ সালে ছাত্র গণঅভ্যুত্থানে যশোর অঞ্চলের নেতৃত্ব দেন খান টিপু সুলতান এবং ১৯৬৯ সালে অনুষ্ঠিত জেলা ছাত্রলীগ সম্মেলনে তিনি জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে ১৯৭০ সালের নির্বাচন ও ১৯৭১ এর সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়ার মাধ্যমে যশোর জেলার আপামর জনগণের কাছে তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চ শিক্ষা নেয়ার উদ্দেশ্যে ঢাকায় আসেন খান টিপু সুলতান। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাঁকে যশোরের জাতীয় রাজনীতিতে যোগ দেয়ার নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধুর আদেশ অমান্য করতে পারেননি তিনি। ঢাকা হতে যশোরে ফিরে গিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যোগ দেন এবং স্থায়ীভাবে যশোরে বসবাস শুরম্ন করেন। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু তাঁকে যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব দেন। বঙ্গবন্ধুর অত্যনত্ম স্নেহভাজন ছিলেন খান টিপু সুলতান।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলে খান টিপু সুলতান বন্দি হন। দুই বছর কারাভোগের পর মুক্তি পেয়ে যশোর জেলা আওয়ামী লীগকে পুন:সংগঠিত করতে সচেষ্ট হন। ১৯৭৮ সালে তাঁর উদ্যোগে যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং এতে যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি। এর পর পরই বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়; এতে তাঁকে কেন্দ্রীয় কমিটির প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচন করা হয়।
১৯৮২ সালে এরশাদ সরকার ক্ষমতা দখলের পর আওয়ামী লীগে আদর্শগত মতবিরোধ দেখা দিলে তিনি সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেন। পরে তিনি যশোর জেলা আওয়ামী লীগের একজন সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এক পর্যায়ে প্রায় ৮ মাস তিনি বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক লীগের হয়ে কাজ করেন। পরবর্তীকালে আবার আওয়ামী লীগে ফিরে যান এবং জেলা কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৫ সালে আবারও যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।
১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে যশোর-৫ (মনিরামপুর) হতে নির্বাচিত হন খান টিপু সুলতান। এ সময় তিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এসময় সংসদীয় কমিটির সভাপতি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে নানা সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেন তিনি। ১৯৯৫ সালে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা সংসদ হতে পদত্যাগ করেন। পরে ১৯৯৬ এর ১ ফেব্রুয়ারি ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ এ নির্বাচন বর্জন করলে তিনি নিজ এলাকায়ও নির্বাচন প্রতিরোধ অন্দোলন গড়ে তোলেন। এক পর্যায়ে সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ফলে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তিনি আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে যশোর-৫ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হন। সংসদ সদস্য হিসেবে তিনি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে সংসদীয় কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই সংসদীয় কমিটিতে থাকা অবস্থায় ২০০১ সালে পূর্ব ইউরোপের দেশ হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে ইউনোস্কর আহবানে বিশ্ব বিজ্ঞান সম্মেলনে তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন। সম্মেলনে বাংলাদেশ রেজুলেশন মুভ করে লবিং-এর মাধ্যমে অনুমোদনের জন্য তাঁরা সফলভাবে কাজ করেন।
২০০১ সালে কমনওয়েলথ পার্লামেন্টের একটি অধিবেশনে প্রতিনিধি হিসেবে তিনি লন্ডনে যান এবং সেখানে হাউজ অব লর্ডস এবং হাউজ অব কমন্স-এর বিভিন্ন সেমিনার ও আলোচনায় অংশ নেন। এ ছাড়া, এই সংসদীয় কমিটিতে যোগাযোগ, পরিবহন ও উন্নয়নের জন্য বিশেষ করে বিআরটিসিকে উন্নত করার জন্য একটি যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় সাব কমিটির আহবায়ক হিসেবে পরামর্শ দেন। এর পর তিনি ভারতের পরিবহন ব্যবস্থা দেখতে যান এবং পশ্চিম বাংলার পরিবহন মন্ত্রীর সঙ্গে একাধিকবার আলোচনা করেন।
১৯৯৬ হতে ২০০১ সাল পর্যন্ত সঠিকভাবে কাজ পরিচালনা করার পর ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এতে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। তবে, ১৯৯৬ এর তুলনায় ২০০১ সালে প্রায় ২৫ হাজার ভোট বেশি পান। তিনি মনে করেন কারচুপির মাধ্যমে সেখানে ৯০ ভাগের বেশি ভোট কাস্টিং দেখানো হয়েছিল। সে কারণে তার পরাজয়।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খান টিপু সুলতান আওয়ামী লীগ হতে মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচনে অংশ নেন এবং বিজয়ী হয়ে জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন।
ইতোমধ্যে সংসদ কর্তৃক গঠিত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ও সরকারী হিসাব সম্পর্কিত পার্লামেন্ট স্টেন্ডিং কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। এছাড়াও তিনি জাতীয় সংসদের স্পীকার কর্তৃক খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেট সদস্য মনোনিত হয়েছেন। বর্তমানে দক্ষতার সঙ্গে উল্লেখিত দায়িত্ব পালন করছেন খান টিপু সুলতান।
জনকল্যাণমূলক কর্মকান্ড:
খান টিপু সুলতান পর পর দুইবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে নির্বাচনী এলাকা মনিরামপুরে ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার আগে তাঁর নির্বাচনী এলাকায় কোন পাকা রাস্তা ছিল না। তিনি সেখানে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার পিচের রাস্তা নির্মাণ করেছেন, প্রতিষ্ঠা করেছেন ১৩৪টি নতুন বেসরকারী প্রাইমারি স্কুল। শুধু তাই নয়, তাঁর সময় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অনেক মাধ্যমিক স্কুল ও মাদ্রাসা এবং ১০টি কলেজ। প্রতিষ্ঠা করেছেন স্বয়ংক্রিয় টেলিফোন এক্সচেঞ্জ। উপজেলার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশে পল্লী বিদুৎ পৌঁছে দেয়ার জন্য তিনি বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছেন। এখানকার জলাবদ্ধতা নিরসনে নদী থেকে পলি অপসরণের জন্য ব্যক্তিগতভাবে যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন পরবর্তীতে তা সরকারী উদ্যোগে পরিণত হয়। এর ফলে খুলনা ও যশোরে ড্রেনেজ প্রকল্পের মাধ্যমে এ পলি নিষ্কাশন করে সেখানে ফসল ফলানো সম্ভব হয়েছে। পরবর্তীকালে আবার সেখানে সমস্যা দেখা দিলে টিপু সুলতান জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সমস্যা সমাধানের জন্য আন্দোলন করেন। অতীতে সংসদ সদস্য থাকা অবস্থায় সরকারী কোষাগার থেকে অর্থ নিয়ে গ্রামীণ জনপদে অবহেলিত নারী ও পুরম্নষের নানা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। সরকারী কর্মকর্তাদের নিয়ে গ্রামে গ্রামে স্বাস্থ্য ও কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন সেমিনার করে জনগণকে স্বাস্থ্য, কৃষি, পশুপালন ও মৎস্য চাষ সম্পর্কে সচেতন করতে কাজ করেছেন। এতে উপকৃত হয়েছে এলাকার জনগণ।
শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ততা:
রাজনীতির পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থেকে এগুলোর উন্নয়নে বিশেষ অবদান রেখেছেন তুখোড় এই রাজনীতিবিদ এ্যাডভোকেট খান টিপু সুলতান। যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- মনিরামপুর ডিগ্রী কলেজ, পাঁচবাড়িয়া মুক্তেশ্বরী ডিগ্রী কলেজ, মদনপুর সম্মিলনী ডিগ্রী কলেজ, রাজগঞ্জ ডিগ্রী কলেজ, কুয়োদা কলেজিয়েট স্কুল, পলাশী কলেজিয়েট স্কুল এবং পাশজোকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়।
আজীবন সদস্য হিসেবে যুক্ত থেকে যে সকল সাংস্কৃতিক সংগঠনের উন্নয়নে কাজ করেছেন সেগুলো হলো-দেড়’শ বছরের পুরাতন যশোর ইনস্টিটিউট পাবলিক লাইব্রেরী, নেহালপুর পাবলিক লাইব্রেরী, খানপুর খমারবাড়ী পাবলিক লাইব্রেরী এবং রাজধানী ঢাকাতে অবস্থিত বাংলা একাডেমী।
সাক্ষাৎকার গ্রহণে:
মোঃ হাসানূজ্জামান বিপুল
সাইদুজ্জামান তুষার
সম্পাদনা:
মোঃ হাসানূজ্জামান বিপুল
ইকবাল করিম নিশান
সর্বশেষ আপডেট:
নভেম্বর ২০১১
More information about Khan Tipu Sultan
shujan.org
sonarbangladesh.com
jessorenews24.com
shokalerkhabor.com
dcjessore.gov.bd
monirampurnews.dhmart.info