
Home রাজনীতিবিদ / Politicians > সৈয়দ মহসীন আলী / Sayed Mohsin Ali (1924-1990)
এই পৃষ্ঠাটি মোট 91433 বার পড়া হয়েছে
সৈয়দ মহসীন আলী / Sayed Mohsin Ali (1924-1990)
সৈয়দ মহসীন আলী
(Sayed Mohsin Ali, Narail)
(Sayed Mohsin Ali, Narail)
.jpg)
পূর্বকথা:
নড়াইল জেলা তথা লোহাগড়া উপজেলার সকলের অত্যন্ত প্রিয় নেতা সৈয়দ মহসীন আলী একজন আদর্শবান রাজনীতিবিদ যার কোন তুলনা নেই। তিনি ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর একজন ঘনিষ্ঠ সহচর। নড়াইল জেলা গণমানুষের নেতা এবং মহান মু্ক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। তিনি ছিলেন একজন সৎ, নিবেদিত এবং খাঁটি দেশ প্রেমিক রাজনীতিবিদ। আমৃত্যু বঙ্গবন্ধুর আদর্শে জীবন ও যৌবনকে উৎস্বর্গ করেছেন দেশ মাতৃকার জন্য। তাঁর জীবনে কোন চাওয়া পাওয়া ছিল না। শুধু একমাত্র রাজনীতি এবং রাজনীতি ছিল তাঁর জীবনের সকল চিন্তা-চেতনায়।
জন্ম ও শৈশব:
সৈয়দ মহসীন আলী নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলার পাঁচুড়িয়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত “সৈয়দ পরিবারে” ১৯২৪ সনের ২৬শে জুন জন্ম গ্রহণ করেন। পিতার নাম সৈয়দ লায়েক আলী, মাতার নামঃ মোছাম্মৎ আয়েশা খাতুন এবং সহধমীনির নাম সৈয়দা রিজিয়া মহসীন। তাঁর পিতা ব্রিটিশ আমলে নিজ পরিবারের “তালুকাদারী” প্রথা/ব্যবসায় নিয়োজিত ছিলেন। উক্ত তালুক হতে খাজনা আদায় করে পরিবারবর্গ জীবিকা নির্বাহ করতেন। উক্ত তালুকদারী প্রথা দেশ বিভাগের পর ১৯৫২/৫৩ সনে বিলোপ পায়।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা:
তিনি নিজ গ্রামে অবস্থিত (স্থাপিত-১৯০৫ সন) পাঁচুড়িয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। অতঃপর ১৯৪৪ সনে লোহাগড়া উচ্চ বিদ্যালয় হতে ম্যাট্রিক পাশ করেন। তাছাড়াও ছোট বেলা হতে তিনি দৈনিক খবরের কাগজ পড়তেন। কেননা তাঁর পিতা উক্ত সময় কলকাতায় কর্মরত ছিলেন এবং প্রায়শই যাতায়াত করতেন।
রাজনীতির সাথে সম্পর্কযুক্ততা:
দ্বিতীয় ব্শ্বি যুদ্ধ কেবল মাত্র শেষ হয়েছে। ১৯৪৬ সনে কমরেড অমল সেনের নেতৃত্বে “তে ভাগা” আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন। ছাত্র জীবন হতে তিনি রাজনীতির সংগে জড়িত হয়ে পড়েন। সেই সুবাদে তিনি বৃহত্তর যশোর জেলার শহীদ মশিউর রহমান এর সাথে পরিচিত হন এবং তাঁর মাধ্যমে বিখ্যাত রাজনীতিবিদ মহান নেতা হোসেন শহীদ সোহরায়ার্দী সাহেবের সংস্পর্শে আসেন এবং তাঁর রাজনৈতিক দর্শন অনুসরণ করেন। ১৯৪৭ সনে দেশ বিভক্তি আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন।
সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড:
তিনি একজন অত্যন্ত সাংস্কৃতিমনা ব্যক্তি ছিলেন। ১৯৪৭ সনে দেশ বিভাগ এর পর (ভারত-পাকিস্তান) যশোরে সেই সময়ে যারা প্রগতিশীল ছাত্র ও যুব আন্দোলন এবং সংস্কৃতি আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন, তিনি ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। সেই সময় নিজ গ্রামের বাড়ীতে “পাঁচুড়িয়া পল্লীবান্ধব” সমিতি নামে একটি সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্র ও লাইব্রেরী গড়ে তোলেন। ঢাকা হতে প্রতিদিন দৈনিক পত্রিকা, সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকা উল্লেখিত লাইব্রেরীতে রাখা হতো।
এবং লোহাগড়া বাজারে " সৈয়দ লাইব্রেরী" নামে একটা। লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করেন। তাছাড়া পাকিস্তান আমলে নরেন সরকার নামের এক ব্যক্তি পাঁচুড়িয়া “সৈয়দ বাড়ীতে” এসে সৈয়দ মহসীন আলীর বাড়ীতে অভিনয় নাচ-গান , আবৃত্তি,শেখাতেন। বছরে একবার নিজ গ্রামের বাড়ীতে কবিতা আবৃত্তি, গান, নাটক মঞ্চস্থ হতো বলে সুধিজনেরা বলে থাকেন। এবং লোহাগড়া রামনারায়ন পাবলিক লাইব্রেরির অন্যতম সদস্য হিসেবে ঐ লাইব্রেরী ভবন ১৯৬২ সালে রিকুইজিশন হয়ে যাওয়া থেকে রিকুইজিশনমুক্ত করার জন্য বিশেষ ভূমিকা রাখেন এবং ১৯৬৫ সালে লাইব্রেরী কে পুনরুজীবিত করার জন্য অ্যাডভোকেট মকবুল হোসেন, আনেয়ারুজ্জামান, সৈয়দ গোলাম মোস্তফা, অলোকানন্দ দাশ, মুন্সি আতিয়ার রহমান, খন্দকার নজরুল ইসলাম প্রমুখ কে সাথে নিয়ে দুঃসময়ে এই প্রতিষ্ঠান কে বাঁচানোর জন্য হাল ধরেছিলেন শক্ত হাতে। এবং তিনি সফল ও হয়েছিলেন।
রাজনীতি:
১৯৪৮ সনের মার্চ মাসে দেশ বিভাগের পর সিপি আই এর ছাত্র সংগঠন স্টুডেন্ট ফেড়ারেশন দ্বারা উৎজিবিত হয়ে “রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ” ব্যানারে নড়াইল মহকুমায় ছাত্র ধর্মঘট সামনের সারির ভূমিকা রাখেন। ১৯৫০ সনে তিনি তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সর্ম্পক যুক্ত হন। সেই সুবাদে যশোর জেলা সম্মেলনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতিতে যশোরের রওশন আলী সাহেবের পরিচালনায় জেলা কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ঐ সময় তিনি লোহাগড়া আওয়ামী লীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদক এবং পরে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। সেই সময় নড়াইল-লোহাগড়া ও কালিয়ার হাতে গোনা আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা ছিলেন। তন্মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য ছিলেন কালিয়ার জনাব এখলাস উদ্দিন সাহেব, নড়াইলের এ্যাড. আফসার উদ্দিন, খন্দকার আব্দুল হাফিজ, এম এ আহাদ, দ্বীনবন্ধু বালা, মুন্সী আতিয়ার রহমান, এ্যাড ওয়ালিউর রহমান এবং আনোয়ারুজ্জামান প্রমুখ।
যুক্তফ্রন্টের কর্মকান্ড:
১৯৫৪ সনের দিকে যুক্তফ্রন্ট এর নির্বাচন ঘিরে তদানিন্তন আওয়ামী লীগও মুসলীম লীগের মধ্যে প্রচন্ড বিরোধ ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বলিয়ান হয়ে সৈয়দ মহসীন আলী অত্যন্ত দৃঢ়তা ও সততার সাথে দলীয় কর্মকান্ডে নিজেকে নিয়োজিত করেন। উক্ত সময় নড়াইল মহকুমা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন এ্যাড আফসার উদ্দিন সাহেব। সেই সময় সৈয়দ মহসীন আলী নড়াইল মহকুমা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি দায়িত্ব পালন করেন। যুক্ত ফ্রন্টের একজন দায়িত্বশীল রাজনৈতিক নেতা হিসাবে কর্মকান্ড পরিচালনা করেন।
শিক্ষা আন্দোলন , ৬ দফা ও আগরতলা
সৈয়দ মহসীন আলী ১৯৬২ সনের শিক্ষা আন্দোলন নড়াইল-লোহাগড়ায় জোরালো ভূমিকা পালন করেন। ৫২ সনের ভাষা আন্দোলন, ৫৪ সনের যুক্ত ফ্রন্টের নির্বাচন, ৬২ শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬ সনে বাঙালী জাতির মুক্তি সনদ ৬ (ছয়) দফা আন্দোলন এবং ৬৮ সনের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। উক্ত আন্দোলনের সময় তিনি বেশ কয়েকবার কারাবন্দি ছিলেন। বিশেষ উল্লেখ্য যে সৈয়দ মহসীন আলী উক্ত সময় রাজশাহী কেন্দ্রীয় জেলখানায় বঙ্গবন্ধুর পাশের সেলে রাজবন্দি হিসাবে কারাবন্দি ছিলেন। তাছাড়াও ১৯৬৬ সনে খুলনায় ৬ দফা পেশ করার জন্য বঙ্গবন্ধু খুলনায় জনসভায় সৈয়দ মহসীন আলী মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধুর সাথে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক আলোচনা হয়।
৬৯ গণ অভ্যুখান ও ৭০ এর নির্বাচণ:
সৈয়দ মহসীন আলী ৬৯ এর গণ আন্দোলনে নড়াইল-লোহাগড়ায় দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য অগ্রনী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭০ সনের জাতীয় নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জনাব খন্দকার আব্দুল হাফিজকে নড়াইল-লোহাগড়া আসন হতে এমএনএ নির্বাচনে তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধ:
১৯৭১ সনে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় লোহাগড়ার অন্যতম মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসাবে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ এর ভাষণের পর লোহাগড়া থানা এলাকায় জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেন এবং শত্রু বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের নির্বাক সৈনিক হিসাবে মুক্তি যুদ্ধে তাহার যে, জনগণকে সংগঠিত করার ভূমিকা ছিল,তাহা নড়াইল-লোহাগড়াবাসী আজীবন স্মরণ রাখবে। উক্ত সময় লোহাগড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের উত্তর পাশে তাঁর একটি বাড়ি ছিল। উক্ত বাড়ীতে তিনি, বাঙালী সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং মুক্তিবাহিনীর অস্ত্র ভান্ডার ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তুলেন। ফলশ্রুতিতে রাজাকার ও পাকবাহিনী উক্ত বাড়ীতে আগুন দিয়ে জ্বালীয়ে পুড়িয়ে দেয় এবং সৈয়দ মহসীন আলীকে ১ নম্বর আসামি করে। ফলে উক্ত বাড়ীতে ১৯৪৭ সন হতে ৭০ সন পর্যন্ত সকল রাজনৈতিক কাগজপত্র/ ডায়রী এবং সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলি পুড়ে নষ্ট হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের বাকী সময় তিনি লোহাগড়া থানার বিভিন্ন ইউনিয়ন ও গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেন এবং একজন সফল সংগঠক হিসাবে ০৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ সনে লোহাগড়া থানা হানাদার মুক্ত করতে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেন। সেজন্য প্রতিবছর লোহাগড়া উপজেলায় ৮ই ডিসেম্বরকে হানাদার মুক্ত দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
পাঁচুড়িয়ার “সৈয়দ বাড়ী” মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার:
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে লোহাগড়া উপজেলা দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ মুক্তিযোদ্ধা উপজেলা হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। তন্মধ্যে লোহাগড়া উপজেলার পাঁচুড়িয়া গ্রামের “সৈয়দ বাড়ী”র ভূমিকা প্রশংসনীয়। একই বাড়ী হতে অধিক সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। সেজন্য সৈয়দ মহসীন আলীর একক অনবদ্য ভূমিকা রয়েছে। ব্রিশিট ভারত, পাকিস্তান আমল হতে সৈয়দ মহসীন আলী রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিলেন। তাঁর বাড়িতে দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকা পড়ার জন্য উদীয়মান শিক্ষিত এবং রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তিদের আগমন ঘটতো। সৈয়দ মহসীন আলী তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ দেশ প্রেমের উজ্বল নক্ষত্র হিসাবে এলাকায় সুপরিচিত ছিলেন। সে কারণে অনেক রাজনীতিবিদ ও শিক্ষিত লোকদের ভীড় থাকতো তাঁর নিজ গ্রাম পাঁচুড়িয়ায়। সাধারণ জনগণদের দেশের তৎকালীন সর্বশেষ রাজনৈতিক অবস্থা জানানোর জন্য বিভিন্ন ইউনিয়ন ও গ্রামে গ্রামে জনসভা / উঠান বৈঠক করে করণীয় ঠিক করতেন এবং রাজনৈতিক দীক্ষা দিতেন। তিনি ছিলেন নির্লোভ এবং সাদামাটা জীবন যাপনে অভ্যস্থ এবং সাদা পাজামা পাঞ্জাবী উপর মুজিব কোট পরিধানে অভ্যস্থ। ছিলেন। দেশমাতৃকার সেবার জন্য তিনি ছিলেন এক অনন্য রাজনৈতিক কারিগর। অনেক মুক্তিযোদ্ধা যারা বেঁচে আছেন এখনো তাঁরা এক বাক্যে স্বীকার করবেন সৈয়দ মহসীন আলী এক বীর মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক এবং তাঁর “সৈয়দ বাড়ীটি” ছিল মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার। যে কারণে পাঁচুড়িয়া গ্রামের পার্শবর্তী ইউনিয়ন ও গ্রাম হতে ১৯৭১ সনে অনেক মুক্তিযোদ্ধার জন্ম হয়। বিশেষ উল্লেখ্য ১৯৭১ সনে পাঁচুড়িয়া গ্রাম কয়েকবার রাজাকার ও পাক মিলিশিয়া আক্রমন করতে এসে মুক্তিযোদ্ধার প্রতিরোধ পশ্চাৎপদ হতে বাধ্য হয়েছে।
স্বাধীন বাংলাদেশে কর্মকান্ড:
১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সনে বাংলাদেশ বিজয় অর্জন করে। ১৯৭২ সনের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগার হতে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশে আগমন করেন। ২৯শে জানুয়ারি নড়াইল মহকুমার কয়েকজন নেতাসহ তিনি ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে, দেশ গড়ার কাজে নিজেকে আবার মনোনিবেশ করেন। তখন এই এলাকায় সৈয়দ মহসীন আলী সাহেব অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা প্রত্যায়ন পএ প্রদান করতেন। ১৯৭৩ সনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদীয় আসন-৯৪ (নড়াইল-২) আসনের প্রধান সমন্বয়কারী দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়ে অত্যান্ত সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন সৈয়দ মহসীন আলী এবং আওয়ামী লীগ প্রার্থী খন্দকার আব্দুল হাফিজ উক্ত নির্বাচনে নির্বাচিত হন।
১৯৭৫ সনের পট পরিবর্তন:
১৯৭৫ সনের ১৫ই আগষ্ট জাতির পিতাকে হত্যা করে সরকার বদলের পরে নড়াইলের রাজনীতির যে কয়েক জন নেতা হাল ধরেন তাদের মধ্যে সৈয়দ মহসীন আলী অন্যতম। দলের নেতা কর্মীদের সংগঠিত করেন এবং দলকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। উক্ত সময় তিনি মহকুমা আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন।
জননেত্রী শেখ হাসিনার দেশে প্রত্যাবর্তন ও উন্নয়ন:
১৯৮১ সনে ১৭ই মে জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফেরৎ আসার পর সৈয়দ মহসীন আলী দল গোছানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেন ও এই এলাকার নেতা কর্মী দের সংগঠিত করে দলকে এগিয়ে নেয়ার কাজে নিয়োজিত ছিলেন।
১৯৮৬ সনে নড়াইল জেলা আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে সকলের প্রিয় নেতা জনাব সালাহউদ্দিন ইউসুফ ও জনাব তোফায়েল আহমেদ এর উপস্থিতিতে সর্বসম্মতিক্রমে জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি হিসাবে নির্বাচিত হন। তিনি দলের কেন্দ্রীয় কমিটির কাউন্সিলার হিসাবে বেশ কয়েকবার ঢাকায় এসে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। সৈয়দ মহসীন আলীর একটা বিরাট স্বপ্ন ছিল বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশের প্রধানমন্ত্রী পদে অধিস্থ হবেন। কিন্তু তাঁর দুর্ভাগ্য সে স্বপ্ন তিনি দেখে যেতে পারেন নি। তাছাড়াও সৈয়দ মহসীন আলীর আরো স্বপ্ন ছিল পদ্মা নদীর উপর একটি সেতু এবং লোহাগড়া মধুমতি নদীর উপর আরেকটি সেতু দেখে যাওয়ার। জননেত্রী শেখ হাসিনা ৪ বার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন এবং বর্তমানে পদ্মা ও কালনা সেতু নির্মাণাধীন। কিন্তু সৈয়দ মহসীন আলী এক অতৃপ্ত বুক ভরা বেদনা নিয়ে সকলের মায়া ত্যাগ করে পরকালে চলে যান।
স্মরনীয়:
উলেখ্য যে ১৯৯৮ সালে নড়াইল-২ আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য শরীফ খসরু জামান, উপজেলা পরিষদ এবং জেলা ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের আন্তরিক সহযোগিতায় সৈয়দ মহসীন আলীর দীর্ঘ সফল রাজনৈতিক জীবনকে স্মরনীয় করে রাখতে ৮ টি মাইল ফলক দিয়ে কোলা পাঁচুড়িয়া থেকে ধলইতলা পর্যন্ত ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ রাস্তা "সৈয়দ মহসীন আলী" সড়ক হিসেবে নামকরণ করে ফলক উন্মোচন করেন।
শেষ কথা:
অকুতোভয় এই মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক সৈয়দ মহসীন আলী বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট রাজনৈতিক সহচর হিসাবে অত্যন্ত নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততার সাথে দলের কর্মকান্ড পরিচালনা করেছেন। জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত নড়াইল জেলা আওয়ামী লীগের আজীবন সহ-সভাপতি হিসাবে কর্মরতাবস্থায় যশোরের রওশন আলী সাহেবের আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে ২৬শে মার্চ ১৯৯০ সনে স্বাধীনতা দিবসের বিশেষ আলোচক হিসাবে আমন্ত্রন পত্র পান। উক্ত আলোচনা সভায় যোগদানের জন্য ২৫শে মার্চ নিজ বাড়ী পাঁচুড়িয়া হতে যশোরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। পথিমধ্যে ঐদিন অর্থাৎ ১৯৯০ সনের ২৫শে মার্চ সকাল ১০:৩০ ঘটিকায় তিনি হৃদ রোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর অকাল মৃত্যুতে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা এবং তৎকালিন দলের সাধারণ সম্পাদক বেগম সাজেদা চৌধুরী শোক বার্তা পাঠান। উক্ত শোক বার্তায় সৈয়দ মহসীন আলীর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অবসানে আওয়ামী লীগ একজন একনিষ্ঠ, প্রকৃত সংগঠক ও ত্যাগী নেতাকে হারানোর জন্য সমবেদনা প্রদান করেন। উক্ত শোক বার্তা দেশের বিভিন্ন জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। মাত্র ৬৬ বছর বয়সে নড়াইলের এই কৃতি সন্তান আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে যান। মৃত্যু কালে তিনি স্ত্রী, দুই পুত্র ও ৪ কন্যা সন্তানসহ অনেক গুনগ্রাহী রেখে যান। আমরা সকলে মরহুম সৈয়দ মহসীন আলীর বিদেহী আত্নার মাগফেরাত কামনা করি। পরকালে তিনি যেন ভালো থাকেন এবং মহান সৃষ্টি কর্তা তাকে “জান্নাতুল ফেরদৌস” প্রদান করেন। "
তথ্যসূত্র:
জন্ম ও শৈশব:
সৈয়দ মহসীন আলী নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলার পাঁচুড়িয়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত “সৈয়দ পরিবারে” ১৯২৪ সনের ২৬শে জুন জন্ম গ্রহণ করেন। পিতার নাম সৈয়দ লায়েক আলী, মাতার নামঃ মোছাম্মৎ আয়েশা খাতুন এবং সহধমীনির নাম সৈয়দা রিজিয়া মহসীন। তাঁর পিতা ব্রিটিশ আমলে নিজ পরিবারের “তালুকাদারী” প্রথা/ব্যবসায় নিয়োজিত ছিলেন। উক্ত তালুক হতে খাজনা আদায় করে পরিবারবর্গ জীবিকা নির্বাহ করতেন। উক্ত তালুকদারী প্রথা দেশ বিভাগের পর ১৯৫২/৫৩ সনে বিলোপ পায়।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা:
তিনি নিজ গ্রামে অবস্থিত (স্থাপিত-১৯০৫ সন) পাঁচুড়িয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। অতঃপর ১৯৪৪ সনে লোহাগড়া উচ্চ বিদ্যালয় হতে ম্যাট্রিক পাশ করেন। তাছাড়াও ছোট বেলা হতে তিনি দৈনিক খবরের কাগজ পড়তেন। কেননা তাঁর পিতা উক্ত সময় কলকাতায় কর্মরত ছিলেন এবং প্রায়শই যাতায়াত করতেন।
রাজনীতির সাথে সম্পর্কযুক্ততা:
দ্বিতীয় ব্শ্বি যুদ্ধ কেবল মাত্র শেষ হয়েছে। ১৯৪৬ সনে কমরেড অমল সেনের নেতৃত্বে “তে ভাগা” আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন। ছাত্র জীবন হতে তিনি রাজনীতির সংগে জড়িত হয়ে পড়েন। সেই সুবাদে তিনি বৃহত্তর যশোর জেলার শহীদ মশিউর রহমান এর সাথে পরিচিত হন এবং তাঁর মাধ্যমে বিখ্যাত রাজনীতিবিদ মহান নেতা হোসেন শহীদ সোহরায়ার্দী সাহেবের সংস্পর্শে আসেন এবং তাঁর রাজনৈতিক দর্শন অনুসরণ করেন। ১৯৪৭ সনে দেশ বিভক্তি আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন।
সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড:
তিনি একজন অত্যন্ত সাংস্কৃতিমনা ব্যক্তি ছিলেন। ১৯৪৭ সনে দেশ বিভাগ এর পর (ভারত-পাকিস্তান) যশোরে সেই সময়ে যারা প্রগতিশীল ছাত্র ও যুব আন্দোলন এবং সংস্কৃতি আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন, তিনি ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। সেই সময় নিজ গ্রামের বাড়ীতে “পাঁচুড়িয়া পল্লীবান্ধব” সমিতি নামে একটি সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্র ও লাইব্রেরী গড়ে তোলেন। ঢাকা হতে প্রতিদিন দৈনিক পত্রিকা, সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকা উল্লেখিত লাইব্রেরীতে রাখা হতো।
এবং লোহাগড়া বাজারে " সৈয়দ লাইব্রেরী" নামে একটা। লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করেন। তাছাড়া পাকিস্তান আমলে নরেন সরকার নামের এক ব্যক্তি পাঁচুড়িয়া “সৈয়দ বাড়ীতে” এসে সৈয়দ মহসীন আলীর বাড়ীতে অভিনয় নাচ-গান , আবৃত্তি,শেখাতেন। বছরে একবার নিজ গ্রামের বাড়ীতে কবিতা আবৃত্তি, গান, নাটক মঞ্চস্থ হতো বলে সুধিজনেরা বলে থাকেন। এবং লোহাগড়া রামনারায়ন পাবলিক লাইব্রেরির অন্যতম সদস্য হিসেবে ঐ লাইব্রেরী ভবন ১৯৬২ সালে রিকুইজিশন হয়ে যাওয়া থেকে রিকুইজিশনমুক্ত করার জন্য বিশেষ ভূমিকা রাখেন এবং ১৯৬৫ সালে লাইব্রেরী কে পুনরুজীবিত করার জন্য অ্যাডভোকেট মকবুল হোসেন, আনেয়ারুজ্জামান, সৈয়দ গোলাম মোস্তফা, অলোকানন্দ দাশ, মুন্সি আতিয়ার রহমান, খন্দকার নজরুল ইসলাম প্রমুখ কে সাথে নিয়ে দুঃসময়ে এই প্রতিষ্ঠান কে বাঁচানোর জন্য হাল ধরেছিলেন শক্ত হাতে। এবং তিনি সফল ও হয়েছিলেন।
রাজনীতি:
১৯৪৮ সনের মার্চ মাসে দেশ বিভাগের পর সিপি আই এর ছাত্র সংগঠন স্টুডেন্ট ফেড়ারেশন দ্বারা উৎজিবিত হয়ে “রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ” ব্যানারে নড়াইল মহকুমায় ছাত্র ধর্মঘট সামনের সারির ভূমিকা রাখেন। ১৯৫০ সনে তিনি তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সর্ম্পক যুক্ত হন। সেই সুবাদে যশোর জেলা সম্মেলনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতিতে যশোরের রওশন আলী সাহেবের পরিচালনায় জেলা কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ঐ সময় তিনি লোহাগড়া আওয়ামী লীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদক এবং পরে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। সেই সময় নড়াইল-লোহাগড়া ও কালিয়ার হাতে গোনা আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা ছিলেন। তন্মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য ছিলেন কালিয়ার জনাব এখলাস উদ্দিন সাহেব, নড়াইলের এ্যাড. আফসার উদ্দিন, খন্দকার আব্দুল হাফিজ, এম এ আহাদ, দ্বীনবন্ধু বালা, মুন্সী আতিয়ার রহমান, এ্যাড ওয়ালিউর রহমান এবং আনোয়ারুজ্জামান প্রমুখ।
যুক্তফ্রন্টের কর্মকান্ড:
১৯৫৪ সনের দিকে যুক্তফ্রন্ট এর নির্বাচন ঘিরে তদানিন্তন আওয়ামী লীগও মুসলীম লীগের মধ্যে প্রচন্ড বিরোধ ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বলিয়ান হয়ে সৈয়দ মহসীন আলী অত্যন্ত দৃঢ়তা ও সততার সাথে দলীয় কর্মকান্ডে নিজেকে নিয়োজিত করেন। উক্ত সময় নড়াইল মহকুমা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন এ্যাড আফসার উদ্দিন সাহেব। সেই সময় সৈয়দ মহসীন আলী নড়াইল মহকুমা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি দায়িত্ব পালন করেন। যুক্ত ফ্রন্টের একজন দায়িত্বশীল রাজনৈতিক নেতা হিসাবে কর্মকান্ড পরিচালনা করেন।
শিক্ষা আন্দোলন , ৬ দফা ও আগরতলা
সৈয়দ মহসীন আলী ১৯৬২ সনের শিক্ষা আন্দোলন নড়াইল-লোহাগড়ায় জোরালো ভূমিকা পালন করেন। ৫২ সনের ভাষা আন্দোলন, ৫৪ সনের যুক্ত ফ্রন্টের নির্বাচন, ৬২ শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬ সনে বাঙালী জাতির মুক্তি সনদ ৬ (ছয়) দফা আন্দোলন এবং ৬৮ সনের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। উক্ত আন্দোলনের সময় তিনি বেশ কয়েকবার কারাবন্দি ছিলেন। বিশেষ উল্লেখ্য যে সৈয়দ মহসীন আলী উক্ত সময় রাজশাহী কেন্দ্রীয় জেলখানায় বঙ্গবন্ধুর পাশের সেলে রাজবন্দি হিসাবে কারাবন্দি ছিলেন। তাছাড়াও ১৯৬৬ সনে খুলনায় ৬ দফা পেশ করার জন্য বঙ্গবন্ধু খুলনায় জনসভায় সৈয়দ মহসীন আলী মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধুর সাথে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক আলোচনা হয়।
৬৯ গণ অভ্যুখান ও ৭০ এর নির্বাচণ:
সৈয়দ মহসীন আলী ৬৯ এর গণ আন্দোলনে নড়াইল-লোহাগড়ায় দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য অগ্রনী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭০ সনের জাতীয় নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জনাব খন্দকার আব্দুল হাফিজকে নড়াইল-লোহাগড়া আসন হতে এমএনএ নির্বাচনে তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধ:
১৯৭১ সনে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় লোহাগড়ার অন্যতম মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসাবে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ এর ভাষণের পর লোহাগড়া থানা এলাকায় জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেন এবং শত্রু বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের নির্বাক সৈনিক হিসাবে মুক্তি যুদ্ধে তাহার যে, জনগণকে সংগঠিত করার ভূমিকা ছিল,তাহা নড়াইল-লোহাগড়াবাসী আজীবন স্মরণ রাখবে। উক্ত সময় লোহাগড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের উত্তর পাশে তাঁর একটি বাড়ি ছিল। উক্ত বাড়ীতে তিনি, বাঙালী সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং মুক্তিবাহিনীর অস্ত্র ভান্ডার ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তুলেন। ফলশ্রুতিতে রাজাকার ও পাকবাহিনী উক্ত বাড়ীতে আগুন দিয়ে জ্বালীয়ে পুড়িয়ে দেয় এবং সৈয়দ মহসীন আলীকে ১ নম্বর আসামি করে। ফলে উক্ত বাড়ীতে ১৯৪৭ সন হতে ৭০ সন পর্যন্ত সকল রাজনৈতিক কাগজপত্র/ ডায়রী এবং সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলি পুড়ে নষ্ট হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের বাকী সময় তিনি লোহাগড়া থানার বিভিন্ন ইউনিয়ন ও গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেন এবং একজন সফল সংগঠক হিসাবে ০৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ সনে লোহাগড়া থানা হানাদার মুক্ত করতে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেন। সেজন্য প্রতিবছর লোহাগড়া উপজেলায় ৮ই ডিসেম্বরকে হানাদার মুক্ত দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
পাঁচুড়িয়ার “সৈয়দ বাড়ী” মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার:
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে লোহাগড়া উপজেলা দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ মুক্তিযোদ্ধা উপজেলা হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। তন্মধ্যে লোহাগড়া উপজেলার পাঁচুড়িয়া গ্রামের “সৈয়দ বাড়ী”র ভূমিকা প্রশংসনীয়। একই বাড়ী হতে অধিক সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। সেজন্য সৈয়দ মহসীন আলীর একক অনবদ্য ভূমিকা রয়েছে। ব্রিশিট ভারত, পাকিস্তান আমল হতে সৈয়দ মহসীন আলী রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিলেন। তাঁর বাড়িতে দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকা পড়ার জন্য উদীয়মান শিক্ষিত এবং রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তিদের আগমন ঘটতো। সৈয়দ মহসীন আলী তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ দেশ প্রেমের উজ্বল নক্ষত্র হিসাবে এলাকায় সুপরিচিত ছিলেন। সে কারণে অনেক রাজনীতিবিদ ও শিক্ষিত লোকদের ভীড় থাকতো তাঁর নিজ গ্রাম পাঁচুড়িয়ায়। সাধারণ জনগণদের দেশের তৎকালীন সর্বশেষ রাজনৈতিক অবস্থা জানানোর জন্য বিভিন্ন ইউনিয়ন ও গ্রামে গ্রামে জনসভা / উঠান বৈঠক করে করণীয় ঠিক করতেন এবং রাজনৈতিক দীক্ষা দিতেন। তিনি ছিলেন নির্লোভ এবং সাদামাটা জীবন যাপনে অভ্যস্থ এবং সাদা পাজামা পাঞ্জাবী উপর মুজিব কোট পরিধানে অভ্যস্থ। ছিলেন। দেশমাতৃকার সেবার জন্য তিনি ছিলেন এক অনন্য রাজনৈতিক কারিগর। অনেক মুক্তিযোদ্ধা যারা বেঁচে আছেন এখনো তাঁরা এক বাক্যে স্বীকার করবেন সৈয়দ মহসীন আলী এক বীর মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক এবং তাঁর “সৈয়দ বাড়ীটি” ছিল মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার। যে কারণে পাঁচুড়িয়া গ্রামের পার্শবর্তী ইউনিয়ন ও গ্রাম হতে ১৯৭১ সনে অনেক মুক্তিযোদ্ধার জন্ম হয়। বিশেষ উল্লেখ্য ১৯৭১ সনে পাঁচুড়িয়া গ্রাম কয়েকবার রাজাকার ও পাক মিলিশিয়া আক্রমন করতে এসে মুক্তিযোদ্ধার প্রতিরোধ পশ্চাৎপদ হতে বাধ্য হয়েছে।
স্বাধীন বাংলাদেশে কর্মকান্ড:
১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সনে বাংলাদেশ বিজয় অর্জন করে। ১৯৭২ সনের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগার হতে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশে আগমন করেন। ২৯শে জানুয়ারি নড়াইল মহকুমার কয়েকজন নেতাসহ তিনি ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে, দেশ গড়ার কাজে নিজেকে আবার মনোনিবেশ করেন। তখন এই এলাকায় সৈয়দ মহসীন আলী সাহেব অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা প্রত্যায়ন পএ প্রদান করতেন। ১৯৭৩ সনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদীয় আসন-৯৪ (নড়াইল-২) আসনের প্রধান সমন্বয়কারী দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়ে অত্যান্ত সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন সৈয়দ মহসীন আলী এবং আওয়ামী লীগ প্রার্থী খন্দকার আব্দুল হাফিজ উক্ত নির্বাচনে নির্বাচিত হন।
১৯৭৫ সনের পট পরিবর্তন:
১৯৭৫ সনের ১৫ই আগষ্ট জাতির পিতাকে হত্যা করে সরকার বদলের পরে নড়াইলের রাজনীতির যে কয়েক জন নেতা হাল ধরেন তাদের মধ্যে সৈয়দ মহসীন আলী অন্যতম। দলের নেতা কর্মীদের সংগঠিত করেন এবং দলকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। উক্ত সময় তিনি মহকুমা আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন।
জননেত্রী শেখ হাসিনার দেশে প্রত্যাবর্তন ও উন্নয়ন:
১৯৮১ সনে ১৭ই মে জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফেরৎ আসার পর সৈয়দ মহসীন আলী দল গোছানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেন ও এই এলাকার নেতা কর্মী দের সংগঠিত করে দলকে এগিয়ে নেয়ার কাজে নিয়োজিত ছিলেন।
১৯৮৬ সনে নড়াইল জেলা আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে সকলের প্রিয় নেতা জনাব সালাহউদ্দিন ইউসুফ ও জনাব তোফায়েল আহমেদ এর উপস্থিতিতে সর্বসম্মতিক্রমে জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি হিসাবে নির্বাচিত হন। তিনি দলের কেন্দ্রীয় কমিটির কাউন্সিলার হিসাবে বেশ কয়েকবার ঢাকায় এসে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। সৈয়দ মহসীন আলীর একটা বিরাট স্বপ্ন ছিল বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশের প্রধানমন্ত্রী পদে অধিস্থ হবেন। কিন্তু তাঁর দুর্ভাগ্য সে স্বপ্ন তিনি দেখে যেতে পারেন নি। তাছাড়াও সৈয়দ মহসীন আলীর আরো স্বপ্ন ছিল পদ্মা নদীর উপর একটি সেতু এবং লোহাগড়া মধুমতি নদীর উপর আরেকটি সেতু দেখে যাওয়ার। জননেত্রী শেখ হাসিনা ৪ বার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন এবং বর্তমানে পদ্মা ও কালনা সেতু নির্মাণাধীন। কিন্তু সৈয়দ মহসীন আলী এক অতৃপ্ত বুক ভরা বেদনা নিয়ে সকলের মায়া ত্যাগ করে পরকালে চলে যান।
স্মরনীয়:
উলেখ্য যে ১৯৯৮ সালে নড়াইল-২ আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য শরীফ খসরু জামান, উপজেলা পরিষদ এবং জেলা ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের আন্তরিক সহযোগিতায় সৈয়দ মহসীন আলীর দীর্ঘ সফল রাজনৈতিক জীবনকে স্মরনীয় করে রাখতে ৮ টি মাইল ফলক দিয়ে কোলা পাঁচুড়িয়া থেকে ধলইতলা পর্যন্ত ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ রাস্তা "সৈয়দ মহসীন আলী" সড়ক হিসেবে নামকরণ করে ফলক উন্মোচন করেন।
শেষ কথা:
অকুতোভয় এই মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক সৈয়দ মহসীন আলী বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট রাজনৈতিক সহচর হিসাবে অত্যন্ত নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততার সাথে দলের কর্মকান্ড পরিচালনা করেছেন। জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত নড়াইল জেলা আওয়ামী লীগের আজীবন সহ-সভাপতি হিসাবে কর্মরতাবস্থায় যশোরের রওশন আলী সাহেবের আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে ২৬শে মার্চ ১৯৯০ সনে স্বাধীনতা দিবসের বিশেষ আলোচক হিসাবে আমন্ত্রন পত্র পান। উক্ত আলোচনা সভায় যোগদানের জন্য ২৫শে মার্চ নিজ বাড়ী পাঁচুড়িয়া হতে যশোরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। পথিমধ্যে ঐদিন অর্থাৎ ১৯৯০ সনের ২৫শে মার্চ সকাল ১০:৩০ ঘটিকায় তিনি হৃদ রোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর অকাল মৃত্যুতে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা এবং তৎকালিন দলের সাধারণ সম্পাদক বেগম সাজেদা চৌধুরী শোক বার্তা পাঠান। উক্ত শোক বার্তায় সৈয়দ মহসীন আলীর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অবসানে আওয়ামী লীগ একজন একনিষ্ঠ, প্রকৃত সংগঠক ও ত্যাগী নেতাকে হারানোর জন্য সমবেদনা প্রদান করেন। উক্ত শোক বার্তা দেশের বিভিন্ন জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। মাত্র ৬৬ বছর বয়সে নড়াইলের এই কৃতি সন্তান আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে যান। মৃত্যু কালে তিনি স্ত্রী, দুই পুত্র ও ৪ কন্যা সন্তানসহ অনেক গুনগ্রাহী রেখে যান। আমরা সকলে মরহুম সৈয়দ মহসীন আলীর বিদেহী আত্নার মাগফেরাত কামনা করি। পরকালে তিনি যেন ভালো থাকেন এবং মহান সৃষ্টি কর্তা তাকে “জান্নাতুল ফেরদৌস” প্রদান করেন। "
তথ্যসূত্র: