
Home যশোর জেলা / Jessore District > বাংলার বার ভূঁইয়া
এই পৃষ্ঠাটি মোট 89565 বার পড়া হয়েছে
বাংলার বার ভূঁইয়া
পাক-ভারতে ৩শ বছর তুর্ক আফগান শাসন চলেছিল। ১৫২৬ খৃষ্টাব্দে মোঘল সম্রাট মহামতি বাবর কর্তৃক সম্রাট ইব্রাহিম লোদী পানি পথে নিহত হবার পরে পাক-ভারতে মোঘল সম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপিত হয়। আফগান, তুর্কী এবং পাঠান শক্তি এ সময়ে হীনবল হয়ে পড়লেও বাংলা বিহার উড়িষ্যা, আসাম অঞ্চলে মোঘল বিরোধী শক্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। ১৫৭৬ খৃষ্টাব্দে আকবর কর্তৃক বাংলা বিজয়ের কাল পর্যন্ত বাংলায় স্বাধীন শাসন যুগ ছিল। সলেমানের পুত্র দাউদ খাঁ কররানী ১৫৭৬ পর্যন্ত বাংলার স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রেখেছিলেন। কিন্তু স্বাধীন পাঠান রাজত্বের পতন হলেও বাংলায় সে সময় মোঘল শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পাঠান শক্তি অকষ্মাৎ পতনে পাঠান ও তুর্কী বিদ্রোহের মনোভাব ধুমায়িত হতে থাকে, তারা বিজয়ী মোঘলদের সাথে নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে নাই। এ বিদ্রোহী পাঠানদের সাথে দেশীয় হিন্দু মুসলিম সামান্ত রাজারাও যোগ দেন। পাঠান রাজত্বের শেষের দিকে বাংলায় বহু জমিদার ও ভূস্বামী প্রবল প্রতাপান্বিত হয়ে ওঠে। এদের বেশীর ভাগই পাঠান, অল্প সংখ্যক হিন্দু সে সময় যে সমস্ত জমিদার। বাবর ও হুমায়ূনের রাজত্বকাল দীর্ঘ স্থায়ী হয়নি। ভূঁইয়াদের আন্দোলন, সংগ্রাম, যুদ্ধ বিগ্রহ বাদশা আকবর ও জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে সংঘটিত হয়েছিল। যারা মোঘল শাসন অস্বীকার করে স্বাধীনভাবে চলার চেষ্টা করত, তারা বাংলার বার ভূঁইয়া নামে পরিচিত। বাংলার বার ভূঁইয়াগণ বাঙালী জাতির ইতিহাসে এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। স্বাধীন বাংলার ইতিহাসে বাংলার বার ভূঁইয়াদের দান অপরিসীম। দাউদের পতনের পর বাংলায় যে গণজাগরণ ও বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল তারই ধারাবাহিকতায় মোঘলদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যারা যুদ্ধ করেন তারা ইতিহাসে বার ভূঁইয়া নামে পরিচিত। ভূঁইয়া শব্দের অর্থ ভূই মালিক, ভৌমিক, ভূম্যধিকারী, রাজা বা জমিদার। প্রভাবশালী রাজা, জমিদার ও স্থানীয় শাসক এই উপাধি গ্রহণ করতেন। অনেক সময় একটি খন্ড রাজ্য বা এক বা একাধিক পরগনার জমিদারীর মালিকেরা ভূঁইয়া উপাধি গ্রহণ করত। ভূঁইয়াদের ব্যক্তিগত বীরত্ব ও নিজস্ব বাহিনীর শক্তির উপর রাজ্যের সম্মান ও প্রতিপত্তি নির্ভর করত। তারা শুধু রাজস্ব আদায় ও জমিদারী ভোগ দখল নিয়ে ব্যস্থ থাকত না তারা শাসন কার্য পরিচালনার জন্য সীমিত সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর সহায়তায় যুদ্ধ পরিচালনা করত। সেজন্য পদাতিক ও নৌ-বাহিনীর পাশাপাশি রাজধানী সংলগ্ন দূর্গ, অস্ত্রাগার, কামান ও গুলাগুলির সংস্থান থাকত। ভূঁইয়াদের ভাটিশ্বর বা নিম্ন বঙ্গের অধিশ্বর করা হত। বর্তমানে বাঙালীরা অনেকেই তাদের নিয়ে গর্ব অনুভব করলেও তারা খাটি দেশপ্রেমিক ছিলেন কি না সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। তারা জোর যার মুল্লুক তার নীতিতে বিশ্বাসী ছিল। স্বাধীনতার প্রতীকে তারা আবদ্ধ ছিল না।
ডুজারিক তার “এশিয়ায় খৃষ্ট ধর্ম” নামক গ্রন্থে সমসাময়িক বাংলাদেশের বিবরণী লিপিবদ্ধ করেছেন, যেখানে বার ভূঁইয়াদের কথায় উল্লেখ আছে। এখানে আরো উল্লেখ আছে বার ভূঁইয়াগণ বারজনে বাংলাদেশ বিভক্ত করে মোঘল শক্তিকে বঙাধিকার থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করত। স্পেনীয় পুরোহিত ম্যানোরিক ১৬২৮ খৃষ্টাব্দ থেকে ১৬৬১ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত, বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা ভ্রমণ শেষে স্বদেশে যেয়ে ভ্রমণ বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করেন। সেখানে বার ভূঁইয়ার উল্লেখ আছে। তার মতে বার ভূঁইয়া বারটি রাজ্যের নাম যথা-
১। বাংলা ২। হিজলী ৩। উড়িষ্যা ৪। যশোর
৫। চণ্ডীকান ৬। মেদিনীপুর ৭। কতাভু ৮। বাকলা
৯। ছলিমানবাদ ১০। ভুলুয়া ১১। ঢাকা ১২। রাজমহল
চণ্ডীকান যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজ্য। যশোর সম্ভাবত চাঁচড়া রাজ্য। মহামতী বিভারিজ বার ভূঁইয়া সম্পর্কে কিছু নতুন তথ্যের সংযোজন করেছেন। ওয়াইজ সাহেব বারজনের মধ্যে ৭ জনের নাম দিয়ে তার মধ্যে পাঁচজনের বিবরণ লিখেছেন। সেই সাত জন হল-
১। ভাওয়ালের ফজল গাজী ২। বিক্রমপুরের চাঁদ রায়, কেদার রায়
৩। ভুলুয়ার লক্ষ্মণমাণিক্য ৪। চন্দ্রদ্বীপ বা বাকলার কন্দর্প নারায়ণ
৫। খিজিরপুরের ঈশা খাঁ ৬। যশোরের বা চ্যাণ্ডিকানের প্রতাপাদিত্য
৭। ভুষণার মুকন্দনারা রাজ।
দেখা যায় ওয়াইজ সাহেবের উল্লেখিত সাত জনের মধ্যে ৫ জন হিন্দু এবং ২ জন মুসলমান। ডুজারিকের তালিকায়ও ক’জনের নাম পাওয়া যায়। যশোর-খুলনার ইতিহাস প্রনেতা সতীশচন্দ্র মিত্র দ্বাদশ বার ভূঁইয়ার ১২ নাম উল্লেখ করেন যথা-
১। ঈশা খাঁ ২। প্রাতপাদিত্য ৩। চাঁদ রায়, কেদার রায়
৪। কন্দর্প নারায়ণ ৫। লক্ষ্মণ মানিক্য ৬। মুকুন্দরাম রায়
৭। ফজল গাজী ৮। হাম্বীর মল্ল ৯। কংসনারায়ণ
১০। রামকৃষ্ণ ১১। পীতাম্বর রায় ১২। ঈসা খাঁ লোহরী ও ওসমান খাঁ
দেখা যায় পর্তুগীজ মিশনারীরা চট্টগ্রাম, সন্দীপ, শ্রীপুর, বাকলা, চণ্ডিকান (যশোর) তথা দক্ষিণ বঙ্গে বেশী আনাগুনা করত। এ সমস্ত রাজ্যে পুর্তুগীজরা তাদের ধর্ম প্রচার করত। ডুজারিক ছিলেন মোঘল আমলের সমসাময়িক। সে জন্য তার গ্রন্থই প্রামান্য দলিল হিসেবে গ্রহণ করা যায়। বার ভূঁইয়া দের মধ্যে হিন্দু মুসলিম হিসেবে ভাগ করলেও সমস্যা থেকে যায়। সমস্যা হল কে কে সেই বার ভূঁইয়া ? সে যুগে যে বার ভূঁইয়া কথার বিশেষ প্রচলন ছিল তা ইংরেজ, ফরাসী পুর্তুগীজ লেখকদের বর্ণনায় পাওয়া যায়। সে সময় তুর্ক আফগান ও মোঘল সংঘর্ষ চলছিল সে সময় বাঙালীরা এক প্রকার দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। সে সময় জমিদার-জমিদারে, রাজায়-রাজায় আত্ম কলহ বিরাজমান ছিল। দেশে ঐতিহাসিক ছিল না বললেই চলে। এমনকি মোঘল আমলের গ্রন্থাদিতেও বিস্তারিত ইতিহাস পাওয়া যায় না। মোঘল আমলে বাংলার বিস্তারিত ইতিহাস না পাওয়ায় বার ভূঁইয়াদের পরিচয় লিপিবদ্ধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে একথা পরিস্কার যে, বার ভূঁইয়ার নেতা বারজনের কম বা বেশী হবে। পাশ্চাত্য লেখকেরা বারজন ভূঁইয়ার উপরেই দোষ দিয়েছেন। তবে আমাদের ধারণা বার ভূইয়া একই সময় বারজন ছিল না। একজনের পর আর একজন আসে। কোন কোন সময় ৫/৭ জনও ছিল। এখনও আমরা এমন কিছু জনপ্রিয় ভূঁইয়াদের কথা উল্লেখ করব। যারা ইতিহাস সাহিত্যের সৃষ্টি কিন্তু আমাদের আলোচ্য ভূঁইয়ার শ্রেণীভূক্ত নন। অনেক ঐতিহাসিক বারভূঁইয়াদের নামের সাথে-বিষ্ণুপুরের হাম্বির মল্ল, ভূষনার মুকন্দরাম, দিনাজপুরের রাজা গনেশ রায়, সাতৌরের রাজা রামকৃষ্ণ, তাহিরপুরের জমিদার কংস নারায়াণ, পুটিয়ার রাজা পিতাম্বর, রাজা গনেশ, যশোরের রাজা সীতারামের কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তাদের কেউই আমাদের আলোচ্য বারভূঁইয়াদের মধ্যে পড়ে না। পঞ্চদশ শতকে ভূষনার রাজা মুকন্দরাম এবং তৎপুত্র সত্রা মোঘলদের অধিনতা স্বীকার করে মোঘলদের পক্ষে বেশ কয়েকটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। যশোরের রাজা সীতারাম আমাদের আলোচ্য সময়ের একশত বছর পরে মুর্শিদকুলিখার সমসাময়িক। কাজেই দেখা যায় আমাদের আলোচ্য সময়কালীন পাঠানদের বীরত্বের ইতিহাস অনেকটা চাপা পড়ে গেছে।
ডুজারিক ও স্যামুয়েল পার্শা প্রনীত ৯জন মুসলমান ভূঁইয়াদের মধ্যে কেউ কেউ এই ঘোড়াঘাট থেকে মোঘলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল বলে জানা যায়। ফলে তাদের কেউ কেউ বারভূঁইয়াদের তালিকাভূক্তির যোগ্যতা রাখে। বাংলার বারভূঁইয়াদের সম্পর্কে সুধী সমাজের কাছে আলোচনার সুবিধার্থে সুনির্দিষ্ট কয়েকজনের নামসহ তাদের পরিচয় সংক্ষিপ্ত আকারে লিপিবদ্ধ করা হলো।
১। ঈসা খাঁ মসনদ-ই-আলা- (খিজিরপুর বাংলা কর্তাভু) ঢাকা ময়মনসিংহ;
২। চাঁদ রায় ও কেদার রায়- (শ্রীপুর বিক্রমপুর) ঢাকা;
৩। কন্দর্পনারায়ণ ও রামচন্দ্র রায়-(বাকলা) বাকেরগঞ্জ;
৪। প্রতাপাদিত্য-(চন্ডিকান-যশোর) খুলনা;
৫। ফজল গাজী- (ভাওয়াল) ময়মনসিংহ ও ঢাকা;
৬। চাঁদ গাজী-(চাঁদপ্রতাপ, মানিকগঞ্জ) ঢাকা;
৭। লক্ষ্মণমাণিক্য- (ভুলুয়া) নোয়াখালী;
৮। ঈসা খান লোহনী ও ওসমান খাঁ (হিজলী ও উড়িষ্যা) মেদিনীপুর।
তথ্য সংগ্রহ :
হাবিব ইবনে মোস্তফা
সম্পাদনা :
মোঃ হাসানূজ্জামান বিপুল
শামিউল আমিন শান্ত
সর্বশেষ আপডেট :
জুলাই ২০১২