
Home শিল্পী / Artist > মুনশী রইস উদ্দিন / Munasi Rais Uddin (1901-1973)
এই পৃষ্ঠাটি মোট 17355 বার পড়া হয়েছে
মুনশী রইস উদ্দিন
Munasi Rais Uddin
পারিবারিক পরিচিতি :
প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ মধুকণ্ঠের অধিকারী একাধিক সংগীত গ্রন্থের প্রণেতা ওস্তাদ মুন্শী রইস উদ্দিন ১৯০১ সালে মাগুরার শ্রীপুর থানার নাকোল গ্রামে ঐতিহ্যবাহী মুন্শী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম মুন্শী আব্বাস উদ্দিন এবং মাতার নাম জোবেদা খাতুন।
শিক্ষা ও কর্মজীবন :
শিশুকাল থেকেই সংগীতের প্রতি তাঁর প্রবল আকর্ষণ ছিল। পিতা ধ্রুপদ ও টপ্পাচর্চা শুনে শুনেই তিনি নিজেকে প্রস্তুত করেন আগামী দিনের শিল্পী হিসেবে।
উচ্চাঙ্গ সংগীতশিল্পী ফুফাতো ভাই শামসুল হকের কাছেই তিনি সংগীতের তালিম নিতে থাকেন। স্কুলজীবন থেকেই বিভিন্ন সংগীত অনুষ্ঠানে গান শোনা এবং সংগীত পরিবেশনই ছিল তাঁর সহজাত প্রবৃত্তি।
সংগীতের সুরের টানে মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি ছুটে যান সংগীতের প্রাণকেন্দ কলকাতায়। প্রখ্যাত সংগীত সাধক নুলো গোপাল বাবুর প্রধান শিষ্য-রাস বিহারী মল্লিকের কাছে ধ্রুপদ ও খেয়ালের তালিম নিতে শুরু করেন তিনি।
আর্থিক সংকট তাঁর কলকাতার সংগীত শিক্ষাজীবনকে ব্যাহত করে। এ সংকট মোচনের জন্যে তিনি ‘ওয়েলম্যান স্টোরে’ সাতাশ টাকা বেতনে সেল্সম্যানের চাকরি গ্রহণ করেন। এখানে এক বিদেশী ষোড়শীর সাথে তাঁর প্রণয় ঘটে। পরবর্তীতে ব্যর্থ প্রেমের কারণে মেয়েটি আত্মহত্যা করলে মনের দুঃখে তিনি গ্রামে ফিরে আসেন।
আর্থিক সংকটের জন্যে তিনি কুষ্টিয়া মিলে চাকরি গ্রহণ করেন। এ সময় তিনি কুষ্টিয়ায় সংগীতের প্রসারকল্পে একটি সংগীত বিদ্যালয় স্থাপন করেন। পরে তিনি মাগুরা, নড়াইল ও খুলনাতেও অনুরূপ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। সংগীতের ওপর উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্যে তাঁর সাধক মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। তিনি পুনরায় কলকাতায় ছুটে আসেন এবং গিরিজা শংকর চক্রবর্তীর প্রতিষ্ঠিত সংগীত ভবনে ভর্তি হন। এখানে তিনি গিরিজা শংকর চক্রবর্তীর ভাগ্নে শ্রী যামিনী গাংগুলীর কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীতের তালিম নিতে শুরু করেন। দীর্ঘদিন শিক্ষাগ্রহণের পর ১৯৪২ সালে কলকাতা সংগীত কলাভবন থেকে সম্মানসূচক সার্টিফিকেট লাভ করেন। ১৯৩৮ সালে ওস্তাদ মুন্শী রইস উদ্দিন (ছদ্দনামে আর মুন্সী অর্থাৎ রবীন মুন্সী নামে) কলকাতা বেতারে সংগীত পরিবেশন করেন।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তিনি ঢাকা বেতারে যোগ দেন। ১৯৫৫ সালে তিনি দেশের খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান বুলবুল ললিতকলা একাডেমীর শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং পরবর্তীতে দীর্ঘ দিন এখানকার অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। বিদ্যালয়ে সংগীতশিক্ষার জন্যে ১৯৬০ সালে তাঁর রচিত ‘প্রবেশিকা সংগীতশিক্ষা পদ্ধতি’ গ্রন্থটি টেক্সট বুক বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত ও প্রকাশিত হয়।
সৃষ্টকর্ম :
ওস্তাদ মুন্শী রইস উদ্দিন ১৯৪০ সালে ‘সরল সঙ্গীতসার’ নামে সংগীতগ্রন্থের একটি পান্ডুলিপি প্রণয়ন করেন। সংগীতশিক্ষা পদ্ধতি নামে আরেকটি গ্রন্থের পান্ডুলিপি ও পদ্মাবতী নামে একটি ‘রাগ’ও সৃষ্টি করেন।
এই খ্যাতিমান সংগীতজ্ঞ অভিনব শতরাগসহ প্রায় সহস্র গীত বন্দেশ রচনা করেছেন। এ সব বন্দেশে রয়েছে ধ্রুপদ, খেয়াল, লক্ষণগীতি, রাগ দোহা, ঠুমরী। এছাড়া মুন্সী রইচ উদ্দিন ‘আলম পিয়া’ ছদ্দ নামে অসংখ্য রাগ ভিত্তিক গান সৃষ্টি করেছেন তাঁর উত্তরসুরীদের জন্য। এক স্মরণযোগ্য সুরের ভুবন সৃষ্টিসহ সংগীত জগতের এ গুণী বরেণ্য পুরুষ অসংখ্য শিষ্য ও সংগীত শিল্পী সৃষ্টি করে গেছেন। আধ্যাত্মিক চিন্তা-চেতনার অধিকারী মুন্সী রইচ উদ্দিন সংগীতের প্রতি যেমন ছিলেন অনুরক্ত তদ্রূপ ইসলামিক অনুশাসনের জীবনযাপনে পরিপূর্ণ আন্তরিক ও অভ্যস্ত।
শিল্পীজীবনের স্বীকৃতি:
‘অভিনব শতরাগ’ গ্রন্থটি রচনার জন্যে ১৯৬৬ সালে তিনি ‘দাউদ সাহিত্য পুরস্কার’ লাভ করেন। সংগীত গবেষণার জন্যে এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিরল অবদানের স্বীকৃতি স্বরুপ ১৯৬৭ সালে তাঁকে প্রেসিডেন্ট স্বর্ণপদক ‘প্রাইড অফ পারফরমেন্স’ সম্মানে ভূষিত করা হয়।
পরলোকগমন :
গুণী ওস্তাদ সুরশিল্পী মুন্শী রইস উদ্দিন ১৯৭৩ সালের ১১ এপ্রিল ঢাকায় পরলোকগমন করেন। এ গুণী শিল্পীকে আজিমপুরের নতুন গোরস্থানে সমাহিত করা হয়।
তথ্য সূত্র :
যশোরের যশস্বী, শিল্পী ও সাহিত্যিক
লেখক : কাজী শওকত শাহী
সম্পাদনা :
মোঃ হাসানূজ্জামান (বিপুল)
সর্বশেষ আপডেট :
ফেব্রুয়ারি ২০১২
---------------------------------------------------------------------------------
বাংলাদেশের সংগীতের ইতিহাসে যে কতিপয় ক্ষণজন্মা পুরুষের নাম নিয়ে গর্ভ করা যায় তাদের মধ্যে ওস্তাদ মুনশি রইস উদ্দিন প্রথম সারির এক ব্যক্তিত্ব। সংগীতের ভূবনে অনন্য সৃজন শীলতার সুদীর্ঘ পথ ধরে এই ব্যক্তিত্বের আগমন ঘটে।
এতিহ্যবাহী যশোর জেলার বর্তমান মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার নাকোল গ্রামের সম্ভ্রান্ত মুন্সি পরিবারে ১৯০১ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলা ১৩০৮ সালের ২৩ শে পৌষ শুক্রবার ওস্তাদ মুনশি রইস উদ্দিনের জন্ম।
লেখাপড়া এবং খেলাধুলার চেয়ে গানবাজনার দিকেই তার ঝোঁক এবং উৎসাহ দেখা যায়। স্কুল শিক্ষকদের কাছে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মুখেমুখে যে সব গান শিখতেন, নিজে নিজে সেগুলো হারমোনিয়ামে তুলতে চেষ্টা করতেন। পিতার অজান্তে ফুফাত ভাই তৎকালীন উচ্চাঙ্গ সংগীত শিল্পী শামসুল হকের কাছে সংগীতের তালিম গ্রহণ করেছিলেন। মেধাবী ছাত্র ছিলেন মুন্সী রইসউদ্দীন। কিন্তু সংসারিক বাধ্যবাধকতার হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য লেখাপড়া ছেড়ে সতের বছর বয়সে ১৯১৭ সালে পালিয়ে কোলকাতা যান। তিনি কোলকাতা গিয়ে সেখানকার প্রসিদ্ধ সংগীতবিদ নুলো গোপাল বাবুর প্রধান শিষ্য রামবিহারী মল্লিকের কাছে ধ্রুপদ ও খেয়ালের তালিম শুরু করেন। কয়েক বছর পর দেশে ফিরে আসেন পিতার ডাকে। পরে তিনি কুষ্টিয়া মিলে চাকুরি নেন এবং সংগীত বিদ্যালয় খুলেন। পরে মাগুরা, নড়াইল ও খুলনাতে সংগীত বিদ্যালয় স্থাপন করেন। উচ্চাঙ্গ সংগীতে প্রশিক্ষণের জন্য আবারও কলকাতায় চলে আসেন সুরের সন্ধানে। স্বগীয়ত গীর্জা শংকর চক্রবর্তী মহাশয়ের কলিকাতা সংগীত কলাভবনে এসে সুদীর্ঘ সন্ধানের সমাপ্তি ঘটলো। পরে গুরুজীর ভাগ্নে স্ত্রী যামিনী গাঙ্গুলীর (ডক্টর অব মিউজিক) তার কাছে প্রথমে পাঠগ্রহণ শুরু করেন। এর পর থেকে শুরু হলো গুরুজীর কাছ থেকে পাঠ গ্রহণের পালা। অতি অল্প দিনের মধ্যেই সেখানে মুন্সী রউচউদ্দিন সংগীতে খুবই খ্যাতি অর্জন করেন। সে কারণে ১৯৪২ সালে তাকে কলিকাতা সংগীত কলাভবন থেকে সূচক সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়। তখন থেকে মুন্সী রউচউদ্দিন কলকাতা বেতারে নিয়মিত গান করতেন। দেশের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বুলবুল ললিত কলা একাডেমির সঙ্গে এর জন্মলগ্ন থেকে (১৯৫৫ সালের ১লা জুলাই) তিনি জড়িত ছিলেন এবং ইন্তেকালের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত একাডেমির অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি সংগীতের অনেক বই রচনা করেন যা রাষ্ট্রীয়ভাবে খ্যাতি অর্জন করে এবং পদক প্রাপ্ত হন। তার উল্লেখযোগ্য সংগীত বইগুলোর মধ্যে ১) ছোটদের সা-রে-গা-মা ২) অভিনব শত রাগ ৩) সংগীত পরিচয় (বোর্ড পাবলিকেশন ৭ম শ্রেণির পাঠ্য পুস্তক) ৪) গীত লহরী (বোর্ড পাবলিকেশন ৯ম, ১০ম শ্রেণির পাঠ্য পুস্তক) ৫) প্রবেশিকা সংগীত শিক্ষা পদ্ধতি (৯ম, ১০ম শ্রেণির অনুমোদিত পাঠ্য পুস্তক) ৬) বিভিন্ন বই সংগীতের উপর রচনা করেন। ওস্তাদ মুন্সী রইচউদ্দিন যে সকল বইয়ের জন্ম পদক প্রাপ্ত সেগুলো হচ্ছে-
১) ১৯৬৬ সালে সংগীতে দাউদ সাহিত্য পুরস্কার।
২) ১৯৬৭ সালে স্বর্ণ পদকসহ প্রেসিডেন্ট পুরস্কার।
৩) ১৯৮৫ সালে ২১ শে পদকের রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে যখন বোর্ড কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পত্রিকায় সংগীত বিষয়ক পান্ডুলিপি দাখিল করার জন্য অনুরোধ জানান। তখন তিনি তার প্রবেশিকা সংগীত শিক্ষা পদ্ধতি পান্ডুলিপি যথাসময়ে বোর্ডে দাখিল করেন। ১৯৬০ সালে তাঁর পান্ডুলিপিই বোর্ডের অনুমোদন লাভ করে।
ওস্তাদ মুন্সী রইসউদ্দিন সংগীত জীবনের শ্রেষ্ঠ পরিচয় অভিনব রাগ রচয়িতা রূপে। সংগীতের সমগ্র ইতিহাসে রাগরচয়িতায় এরকম নাম অতি অল্পই পাওয়া যায়। অভিনব শতরাগে, অভিনব রাগ শতাধিকে প্রায় সহস্য গীত বন্দেশ রচনা করেছেন ওস্তাদ মুন্সী রইসউদ্দিন। ওস্তাদ মুন্সী রইসউদ্দিন ‘আলম পিয়া’ নামেই প্রায় ৩৫৭ টি রাগ সৃষ্টি করেছিলেন। কবি গোলাম মোস্তফা ওস্তাদজীর স্কুল শিক্ষক ছিলেন। পরবর্তীকালে ওস্তাদ মুন্সী রইসউদ্দিন কবি সাহেবের সংগীত শিক্ষক ছিলেন। শুধু তাই নয় এই উপমহাদেশের বহু খ্যাতনামাও দেশ বরেণ্য সংগীত শিল্পী ওস্তাদ মুন্সী রইসউদ্দীনের কাছে সংগীত শিখেছেন। তাদের মধ্যে ভারতের শিল্পী ইলাবমুসুু, শিপ্রাদাস, বাংলাদেশের সানজিদা খাতুন, ফেরদৌসী রহমান, বেদার উদ্দিন আহমেদ, মিলিয়া আলী, লতিফা চৌধুরীসহ বিভিন্ন খ্যাতিমান শিল্পীর নাম উল্লেখযোগ্য।
এইভাবে তিনি গভীর সাধনা করে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর নিরলসভাবে সুর রচনা করে গেছেন। ’৭১ সালের স্বাধীনতা আন্দোলন চলাকালীন অবর্ণনীয় অনিয়ম ও কষ্ট ভোগের কারণেই ১৯৭২ সালে প্রথমবারের মত অসুস্থ হয়ে শয্যাশয়ী হন।
জীবনের দীপ শিখা ম্লান হয়ে এল ধীরে ধীরে। বাতাসে ছড়িয়ে পড়লো বেদনার শোকবহ মুর্ছনা। সুবিশাল সংগীত কর্মজীবনের যাত্রা বিরতীর লগ্ন এলো ঘনিয়ে এল ২৮ শে চৈত্র ১৩৮০ বাংলা ১১ ই এপ্রিল ১৯৭৩ খ্রিঃ তারিখে পরলোকের পারাতারে পাড়ি জমালেন ওস্তাদ মুন্সী রইসউদ্দীন। ওস্তাদ মুন্সী রইচউদ্দীন তিন পুত্র এক কন্যা সন্তানের গর্বিত পিতা ছিলেন। আজিমপুর নতুন গোরস্থানে, ঢুকলেই হাতের ডানে নাতিদীর্ঘ ঝাকরা কদম গাছের ছায়ায় নিরবে ঘুমুচ্ছেন। ওস্তাদ মুন্সী রইসউদ্দিন, জীবনে ঘুমের সাথে তার পরিচয়ের অবকাশ ছিল না বললেই চলে। আজ শুধু ঘুম আর ঘুম।
ওস্তাদ মুনশী রইচ উদ্দীনের স্ত্রী ও সন্তানদের পরিচিতি
স্ত্রীর নামঃ হাজী বেগম আলেয়া খাতুন (সমাজ সেবী)
সন্তানদের পরিচিতিঃ
১। এ, এফ, এম, আলিমুজ্জামান (এম, এ)
বেতার শিল্পীও মিউজিক ডিরেক্টর
শিল্পী কলা একাডেমি।
২। শাহিনা সুলতানা (বেবী) (বি,এ), বেতার শিল্পী ও
অধ্যক্ষা- ওস্তাদ মুন্সী রইসউদ্দন সংগীত বিদ্যালয়,
শেওড়াপাড়া, মিরপুর, ঢাকা।
৩। এ, এফ, এম, আছাদুজ্জামান, (এম, এ, এম, বি, এ)
বেতার শিল্পী।
৪। ডঃ এম, এফ, এম আশিকুজ্জামান (টুলু) বেতারও ব্যান্ড শিল্পী
ও আর্ক ব্যান্ড লিডার এবং সহকারী পরিচালক, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি।
সংগৃহিতঃ
আবু বাসার আখন্দ
সাংবাদিক, মাগুরা।
০১৭১৬২৩২৯৬২