
Home সমাজসেবক / Social worker > মোঃ আনোয়ার হোসেন / Md. Anwar Hossain (1942 - 2009)
এই পৃষ্ঠাটি মোট 17902 বার পড়া হয়েছে
মোঃ আনোয়ার হোসেন / Md. Anwar Hossain (1942 - 2009)
মোঃ আনোয়ার হোসেন
Md. Anwar Hossain
Home District: Jessore
পারিবা

বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও সমাজসেবক অনোয়ার হোসেন ১৯৪২ সালের যশোর কোতয়ালী থানার আলমনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম মরহুম আজিম উদ্দীন এবং মাতা মৃত মজিফান নেছা একজন গৃহিণী ছিলেন।
পেশাগত জীবন:
প্রথম জীবনে তিনি যশোর এম. এম. কলেজে কারণিক পদে চাকরি করতেন। ১৯৬১ সাল হতে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত তিনি এ চাকরি করেন। ১৯৮০ সালে তিনি চাকরিজীবী হতে ব্যবসায়ী হিসেবে কর্মক্ষেত্রের পরিবর্তন ঘটান। তিনি যশোরের মানুষের কাছে একজন সফল ব্যবসায়ী ও সমাজসেবক হিসেবে ব্যাপক পরিচিত।
সেবামুলক কর্মকান্ড:
আনোয়ার হোসেন দেয়ড়া ইউনিয়নের নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন। ইউনিয়নের মানুষের কাছে তিনি ছিলেন অত্যন্ত শ্রদ্ধার একজন মানুষ।
শিক্ষা বিস্তারে ভূমিকা:
ইউনিয়নের চেয়ারম্যান থাকাকালিন তিনি এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। ইউনিয়নের মানুষের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারে তাঁর রয়েছে অসাধারণ ভূমিকা। প্রতিষ্ঠা করেছেন বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আমদাবাদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, চান্দুটিয়ার সি.এ.জি.এম মাধ্যমিক বিদ্যালয়, আরিজপুর আনোয়ার হোসেন রেজিঃ বে-সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, আমদাবাদ ডিগ্রী কলেজ এবং ইউনিয়নে ১০টি কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বর্তমানে ইউনিয়নে ১৯টি গ্রামে ২১টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৪টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৪টি দাখিল মাদ্রাসা ও ২টি ডিগ্রি কলেজ অবস্থিত - এলাকার সকল ছেলেমেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অর্থের অভাবে তাঁর নির্বাচনী এলাকায় কারো পড়াশুনা বন্ধ হয়নি। গরীব ছাত্র/ছাত্রীদের বই সরবরাহসহ বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা করেছেন তিনি। গরীব মেধাবী ছাত্র/ছাত্রীদের পড়াশুনার খরচ বহন করে অনেককে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। অসংখ্য স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, এতিমখানা, মসজিদ, পাঠাগার, সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানসমূহে বই ও নগদ অর্থ সাহায্য দান করে তিনি মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন আনোয়ার হোসেন।
অবকাঠামোগত উন্নয়ন:
১৯৮৩ ইং সালে যশোর সদর উপজেলার দেয়াড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে একটা অবহেলিত প্রত্যন্ত অঞ্চলকে শহরের সাথে পরিচিত করাতে সক্ষম হন তিনি। দেয়াড়া ইউনিয়নের সাথে যশোর শহরে যাতায়াতের জন্য কোন ভাল কাচা রাস্তাও ছিল না - সেখানে বর্তমানে শহরে যাতায়াতের পাকা রাস্তা করা করেছেন, বেশ কিছু ইটের রাস্তাও করেছেন। বর্তমানে এলাকার উৎপাদিত কৃষিপণ্য ইউনিয়ন বাজার থেকেই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করতে পারছে।
কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা:
ইউনিয়নে অনেক অব্যবহৃত সম্পদ আছে যা যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে নিজস্ব আয় বাড়ানো সম্ভব। যেমন: রাস্তার ধারে বনায়ন সৃষ্টি করে স্থায়ী আয়, বিভিন্ন বাজারে অব্যবহৃত জমির উপর মার্কেট নির্মাণ করে বেকারদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ নিজস্ব আয় বৃদ্ধি করা, নিজস্ব মজাপুকুরে মাছ চাষ করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও আয় বৃদ্ধি করা ইত্যাদি। তিনি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় নতুনহাট বাজারে ৪৪টি দোকানের একটি মার্কেট নির্মাণ করেছেন এবং নারাঙ্গালি মজা পুকুর বেকার যুবকদের লীজ দিয়ে মাছ চাষ করিয়েছেন।
বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড:
জনাব আনোয়ার হোসেন ১৯৬১ ইং সাল থেকে এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ক্লাব ও পাঠাগার স্থাপন করে শিক্ষা, সংস্কৃতি, খেলাধুলা উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। এলাকার কৃষকদের সংগঠিত করে সমবায় ভিত্তিতে খাদ্য উৎপাদন শুরু করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন তিনি। এলাকায় চুরি, ডাকাতি ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড বন্ধের জন্য জনগণকে সংগঠিত করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে তিনি অসাধারণ ভূমিকা পালন করেন।
১৯৮৩ ইং সালে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন, কৃষি উৎপাদন, বেকার ছেলেদের সবজি চাষে উদ্ভুতকরণ, কৃষি উপকরণ বিতরণ, রাস্তার ধারে বৃক্ষ রোপন, মাছ চাষ, গবাদি পশু ও ছাগল পালন, হাঁস মুরগী পালন বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও খামার স্থাপন, দুঃস্থ মহিলাদের জন্য সেলাই প্রশিক্ষণ, প্রশিক্ষণ শেষে সেলাই মেশিন বিতরন, হাতের কাজ প্রশিক্ষণ, কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, বেকারদের মাঝে ভ্যান প্রদান, যৌতুক বিহীন বিয়েতে সাইকেল ও নগদ অর্থসহ সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করেন তিনি।
২০০৪ ইং সালে দেয়াড়া ইউনিয়ন বিভিন্ন কাজের মূল্যায়নে যশোর জেলার মডেল ইউনিয়ন হিসাবে স্বীকৃতি পায়। মডেল ইউনিয়ন হিসাবে ডিসেম্বর ২০০৪ সালের মধ্যে শতভাগ সেনিটেশন কভারেজ দেয়া হয় এবং মার্চ ২০০৫ এর মধ্যে শতভাগ জন্ম নিবন্ধন কাজ সম্পন্ন এবং কার্ড বিতরণ করা হয়। হাল নাগাদ করা হয় শিশুদের জন্ম নিবন্ধন এবং একই সাথে রঙিন ছবিসহ কার্ড বিতরন করা হয়। ইউনিয়নে জন্ম নিবন্ধন কার্ড প্রদর্শন ছাড়া বিয়ে হয় না, নেই কোন বাল্য বিবাহ নেই, যৌতুক বিহীন বিবাহ ইত্যাদি সবই চেয়ারম্যান সাহেবের উদ্যোগেই সম্ভব হয়েছে।
ইউনিয়ন কর্মকান্ড পরিদর্শনে ইউ.এস.এ.আই.ডি./ইউ.এন.ডি.পি./এন.আই.এল.জি./এশিয়ান হেলথ সেন্টার, জাপান, রয়েল স্কাউট দল, খুলনা বিভাগীয় রিপোর্টারস ইউনিট ও দেশী এবং বিদেশী এন.জি.ও প্রতিনিধিবৃন্দ ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। ইউনিয়নে শতভাগ ট্যাক্স আদায় হয়। ইউনিয়নে সকল জনসাধারণের উপস্থিতিতে উন্মুক্ত বাজেট আলোচনা ও পাশ করা হয়। এছাড়া সকল এলাকার জনগণের উপস্থিতিতে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হয়। ইউনিয়নের সকল কর্মকান্ডে জনগণকে সম্পৃক্ত করা হয়।
বিভিন্ন উন্নয়ন ও সামাজিক কর্মকান্ডের স্বীকৃতি স্বরূপ বনায়নে (১৯৯২) বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠত্ব এবং যশোর জেলার শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে ১৯৯০, ১৯৯২, ১৯৯৩ সালে। ২০০৫ সালে মোট ৪টি স্বর্ণপদক পেয়েছেন এবং সরকারি ও ইউ.এস.আই.ডি’র ব্যবস্থাপনায় তিনি ইউ.এস.এ/ফিলিপাইন ও মালয়েশিয়া, এছাড়া নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় জাপান, চীন, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া, হংকং, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ভারত, নেপাল, ভূটান, ইংল্যান্ড, ইউ.এ.ই, পাকিস্তান ও সৌদি আরব সফর করেছেন।
আনোয়ার হোসেন ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম মডেল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। বৃক্ষ রোপনসহ বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডে অবদান রাখায় তিনি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পান। তিনি পোল্ট্রি শিল্পের পথিকৃত ছিলেন। যশোরে তিনিই প্রথম আলমনগর দিশারী পোল্ট্রি হ্যাচারী গড়ে তোলেন। যশোর জেলা পোল্ট্রি ব্যবসায়ী সমিতি নেতৃবৃন্দ বলেছেন পোল্ট্রি শিল্প বিকাশে তাঁর অবদান চির স্বরণীয়।
সাংগঠনিক কর্মকান্ড:
প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি- যশোর কপোতাক্ষ লায়ন্স ও ডায়াবেটিক হাসপাতাল, সভাপতি- যশোর শহর সমাজসেবা সমন্বয় পরিষদ, সহ-সভাপতি- রোগী কল্যাণ সমিতি, যশোর সদর হাসপাতাল, সচিব- মেডিসিন ব্যাংক, যশোর সদর হাসপাতাল, সদস্য- শিশু কিশোর সংশোধনী কেন্দ্র (একরো), যশোর, সদস্য- সরকারি বালিকা সদন, যশোর, প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি- খাজা গরীব এ নেওয়াজ বালিকা সদন, আলমনগর প্রভৃতি সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন।
কোষাধ্যক্ষ- রাইটস, যশোর, কমিশনার- বাংলাদেশ স্কাউটস, যশোর জেলা শাখা, সভাপতি- বুলবুল মহিলা সমাজকল্যাণ সংস্থা, যশোর, সভাপতি- প্রত্যাশা, উপশহর, যশোর, সভাপতি- চাঁদেরহাট (শিশু কিশোর সংগঠন), যশোর, লায়ন্স ক্লাব ইন্টারন্যাশনাল। ৩১৫ এ ১’র মাননীয় জেলা গভর্নর এর এ্যাডভাইজার, আজীবন সদস্য- বাংলাদেশ লায়ন্স ফাউন্ডেশন, পরিবার পরিকল্পনা সমিতি, সাহিত্য পরিষদ, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, যশোর ইনস্টিটিউটসহ সমাজকল্যাণ অংগনে বহু প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত ছিলেন।
পরোলোক গমন:
প্রথম যে দিন তুমি এসেছিলে ভবে, কেঁদে ছিলে তুমি হেঁসেছিল সবে, মরিলে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন’ কবিতার এই চয়নের মতোই সকলকে কাঁদিয়ে বিদায় নিলেন রাষ্ট্রীয় স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত দেশের শ্রেষ্ঠ দেয়াড়া মডেল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন। হাজার হাজার মানুষকে শোক সাগরে ভাসিয়ে চির বিদায় নিলেন তিনি। ৯ মার্চ ২০০৮ তারিখ সোমবার দিবাগত রাতে ঢাকার মডার্ন হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। মঙ্গলবার ভোরে যশোরের আরএন রোডস্থ বাসভবনে তাঁর প্রথম নামাজের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সংসদ সদস্য খালেদুর রহমান টিটোসহ শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ অংশগ্রহণ করেন। জেলা সাড়ে দশটার দিকে তাঁর মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হয় নিজ গ্রাম সদরের আলমনগরে। এ সময় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। বেলা ১টার দিকে তাঁর মৃত দেহ নিয়ে যাওয়া হয় তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়া দেয়াড়া মডেল ইউনিয়ন প্রাঙ্গনে। এখানে তাঁর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানান সর্বস্তরের মানুষ। ইউনিয়ন পরিষদ, যশোর জেলা বিএনপি, নগর ছাত্রদল, দেয়াড়া ইউনিয়ন আওয়ামী, ইউনিয়ন ছাত্রদল, বাংলাদেশ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ফোরাম, জেলা যুবদল, ইউনিয়ন যুবদল, আমদাবাদ কলেজ, আরবপুর ইউনিয়ন পরিষদ নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষ তাঁর কফিনে ফুল দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। দেয়াড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে তাঁর নামাজের দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। কয়েক হাজার মানুষ জানাজায় অংশগ্রহণ করেন। পারিবারিক কবরস্থানে পিতা-মাতার কবরের পাশে দাফন করা হয়। শুধু যশোর নয় তাঁর মৃত্যুর সংবাদ শুনে চৌগাছা, ঝিকরগাছাসহ বিভিন্ন উপজেলার মানুষ তাঁকে শেষ বারের মতো দেখার জন্য তাঁর বাড়িতে ভীড় করেন। আনোয়ার হোসেনের মৃত্যুতে যশোরের সকল রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন শোক প্রকাশ করে।
তথ্য সূত্র :
সাক্ষৎকার
ও
গ্রামের কাগজ
সর্বশেষ আপডেট:
অক্টোবর ২০১১