
Home শিল্পী / Artist > মুস্তাফা মনোয়ার / Mustafa Monowar (1935)
এই পৃষ্ঠাটি মোট 19836 বার পড়া হয়েছে
মুস্তাফা মনোয়ার
Mustafa Monowar
পারিবারিক পরিচিতি :
একটা দেশের জন্য একজন মুস্তফা মনোয়ারই যথেষ্ট। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশের জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউটে একটা এনিমেশন কোর্সে বক্তৃতা দেয়ার সময় কথাটা বলেছিলেন প্রখ্যাত কবি পূর্ণেন্দু পাত্রী। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের এক উজ্জ্বল মধ্যমণি মুস্তফা মনোয়ার তাঁর বিভিন্নমুখী শিল্পকর্ম তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছে।
এই বরেণ্য শিল্পী ১৯৩৫ সালের ১লা সেপ্টেম্বর যশোর জেলার মাগুরা (বর্তমান জেলা) মহকুমার শ্রীপুর থানার অন্তর্গত নাকোল গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা কবি গোলাম মোস্তফা বাংলা সাহিত্যের প্রবাদ পুরুষ। মাতা জামিলা খাতুন ছিলেন একজন গৃহিণী। মুস্তফা মনোয়ারের পৈত্রিক নিবাস ঝিনাইদহ জেলার শৈলকূপা থানার মনোহরপুর গ্রামে।
১৯৬৫ সালে ময়মনসিংহ এর মেয়ে মেরীর সঙ্গে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। স্ত্রী মেরী পড়াশোনা শেষ করে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে শিক্ষকতা করতেন। তিনি বেশ কিছুদিন ঢাকা মিউজিক কলেজের প্রিন্সীপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন ছিলেন। শিল্পী মুস্তফা মনোয়ার এক পুত্র ও এক কন্যা সন্তান জনক। পুত্র সাহদত মনোয়ার বাংলাদেশ বিমানের পাইলট এবং কন্যা নন্দিনী মনোয়ার একটি এনজিওতে কর্মরত।
বাল্যজীবন :
মুস্তফা মনোয়ারের মাতৃবিয়োগ ঘটে মাত্র পাঁচ বছর বয়সে। মা না থাকায় গ্রামের সবাই তাঁকে স্নেহ করতো। সবাই চোখে চোখে রাখতে চাইত। যেহেতু মা ছিল না, তবে নিষেধ ছিল না কোনো কাজে। শিশু মুস্তফা মনোয়ার পালিয়ে পালিয়ে গামছা দিয়ে ডোবায়, পুকুরে, বিলে এবং নদীতে মাছ ধরতে যেতেন। সারাক্ষণই তিনি পানিতে থাকতেন। রীতিমত মারধর করে তুলতে হতো তাঁকে। ছোট বেলায় কলকাতায় থাকাকালীন তাঁর প্রিয় খাবার ছিল আইসক্রিম আর চকলেট।
কলকাতায় থাকতে অনেক ছোট বয়স থেকেই মুস্তফা মনোয়ার গ্রামোফোন বাজাতেন। বাবা রেকর্ড বাজালেই মনোয়ার রেকর্ডের সামনে গিয়ে বসে থাকতেন এবং তাঁর পছন্দের গানগুলো রেকর্ড থেকে বের করে দিতে পারতেন। তখন রেকর্ডের গায়ে কিছু লেখা থাকত না এবং রেকর্ডের সবগুলোর চেহারা ছিল একই রকমের। রেকর্ড থেকে পছন্দের গান বের করার এই প্রতিভাটা দেখে তাঁর বাবা বেশ অবাক হতেন এবং বন্ধু-বান্ধবকে ডেকে দেখাতেন। কবি নজরুল ইসলামকেও মুস্তফা মনোয়ারের এই প্রতিভা দেখিয়েছিলেন তাঁর বাবা। এটা তাঁর বাবার ডায়েরীতে আট-নয় পাতাব্যাপী লেখা আছে।
শিক্ষাজীবন :
শিক্ষাজীবনের সূচনা হয়েছিল কলকাতার শিশু বিদ্যাপীঠে। সেখানে ... শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করার পর তাঁর বাবা হুগলি থেকে বাকুড়া হয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। দেশে আসার পর প্রথমে ফরিদপুর তারপর স্থায়ীভাবে ঢাকার শান্তিনগরে বাড়ি কিনলেন।মুস্তফা মনোয়ার মাতৃহীন ছিলেন বলে নারায়ণঞ্জে মেজ বোনের বাড়িতে আশ্রয় গাড়েন। সেখানে নারায়ণগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলে তাঁকে ভর্তি করা হয়।
১৯৫৩ সালে তিনি নারায়ণগঞ্জ সরকারী হাইস্কুল থেকে কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর তিনি কলকাতায় গিয়ে স্কটিশ চার্চ কলেজে সায়েন্সে ভর্তি হন। পড়ালেখায় মনোযোগ তাঁর কোনদিনই ছিল না। তাঁর ওপর আবার কলেজে ভর্তি হয়েছেন সায়েন্সে, অথচ অঙ্কে ভিষণ কাঁচা।
মুস্তফা মনোয়ারদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকতেন এক গুণী লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী। তিনি মাঝে মাধ্যে মুস্তফা মনোয়ারের আঁকা ছবি দেখতেন এবং খুব প্রশংসা করতেন। তিনি বললেন “ছেলেটার এত ভাল গুণটা সায়েন্স পড়ে নষ্ট হবে!” তিনি একদিন মুস্তফা মনোয়ারের বড় ভাবির সঙ্গে তাঁকে কলকাতায় আর্ট কলেজে নিয়ে গেলেন। শিল্পী রমেন চক্রবর্তী তাঁর আঁকাআঁকি দেখে খুশি হয়ে তাঁকে সেখানে ভর্তির ব্যবস্থা করলেন।
সৈয়দ মুজতবা আলী প্রতিভা চিনতে ভূল করেননি। এখানে সমানভাবে চলতে থাকে তাঁর ছবি আঁকা ও গানের চর্চা। আর্ট কলেজে প্রতি বর্ষের পরীক্ষায় তাঁর স্থান ছিল প্রথম। ১৯৫৯ সালে তিনি কোলকাতা সরকারী আর্ট কলেজ থেকে ফাইন আর্টস বিভাগে প্রথম স্থান লাভ করে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন।
পেশাগত জীবন :
পূর্ব পাকিস্তান চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ে প্রভাষক পদে চাকরি শুরু করেছিলেন মুস্তফা মনোয়ার। আর্ট কলেজে তৃতীয় বর্ষের ছাত্র থাকাকালীন তিনি একাডেমী অব ফাইন আর্টস আয়োজিত সর্বভারতীয় চিত্র প্রদর্শনীতে গ্রাফিক্স আর্টস এ স্বর্ণপদক লাভ করেন। এ সময় সর্বভারতীয় যুব উৎসবের প্রদর্শনীতেও তাঁর শ্রেষ্ঠ তেল রং এর জন্যে তিনি স্বর্ণপদক পান। এ সময় মুস্তফা মনোয়ারের জল রং এর ছবি ভারতে খুবই সমাদৃত হয়।
তাঁর এই সুসংবাদে আনন্দিত হয়ে ঢাকা আর্টস কলেজের প্রতিষ্ঠাতা শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন তাঁকে ঢাকা আর্টস কলেজে শিক্ষকতা করার জন্য আমন্ত্রণ জানান। তিনি ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত সেখানে কর্মরত ছিলেন।
১৯৬৪ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনের শুরুতেই তিনি সেখানকার স্টেশন প্রডিউসার হিসেবে যোগ দেন এবং পরবর্তীতে দীর্ঘদিন বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি জাতীয় পারফর্মিং আর্টস একাডেমী, জাতীয় সমপ্রচার একাডেমী এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশ ফিল্ম উন্নয়ন কর্পোরেশনের মহাপরিচালকের দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে অবসর গ্রহণ করেন।
বাংলাদেশ টেলিভিশনের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বমুস্তফা মনোয়ারের প্রচেষ্টায় টেলিভিশনের গতানুগতিক অনুষ্ঠানমালার এক আশ্চর্য রকমের পরিবর্তন সাধিত হয়। টেলিভিশনে নতুন শৈলীর অনুষ্ঠান নির্মাণে তিনি বরাবর অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেছেন। টেলিভিশনে তাঁর প্রযোজিত শেক্সফিয়ারের ‘ট্রেমিং আব দি শ্রু’র মুনীর চৌধুরী অনূদিত বাংলা টেলিভিশন নাটক ‘মুখরা রমণী বশীকরণ’ এবং রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকবরী’ ইতিহাস সৃষ্টি করে আছে। এই নাটক দুটি যুক্তরাজ্যের গ্রানাডা টিভির ‘ওয়াল্ড হিস্ট্রি অব টিভি ড্রামা’র জন্য মনোনীত হয়। টেলিভিশনে শিশু-কিশোরদের প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান ‘নতুন কুঁড়ি’র তিনি ছিলেন মুখ্য পরিকল্পক, সার্কভুক্ত দেশের টেলিভিশনের জন্য নির্মিত শিশুদের শিক্ষামূলক ‘মীনা কার্টুন’ বা অ্যানিমেশন ফিল্মের পরিকল্পকদের মধ্যেও তাঁর অবস্থান বেশ পোক্ত ছিল। টেলিভিশনের ছোট স্টুডিওতে ত্রিমাত্রিকতা রচনা করে তিনি তাঁর উদ্ভাবনী ক্ষমতার প্রকাশ করেন।
চিত্রশিল্পে তাঁর স্বত:ফুর্ত পদচারণা, বাংলাদেশে নতুন শিল্প আঙ্গিক পাপেটের বিকাশ, টেলিভিশন নাটক প্রযোজনায় অতুলনীয় কৃতিত্ব প্রদর্শন, শিল্পকলার উদার ও মহৎ শিক্ষক হিসেবে নিজেকে মেলে ধরা, দ্বিতীয় সাফ গেমসের মিশুক নির্মাণ এবং ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পেছনের লাল রঙের সূর্যের প্রতিরূপ স্থাপনাসহ শিল্পের নানা পরিকল্পনায় তিনি বরাবর তাঁর সৃজনী ও উদ্ভাবনী প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন।
শিল্পীজীবন :
কবি-পরিবারে জন্ম হওয়ায় পারিবারিকজীবন ছায়ায় বসে শিশুকালেই শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন দেখেন, শিশু বয়সেই নরম হাতের ছোঁয়ায় সুন্দর সুন্দর ছবি আঁকতেন তিনি। প্রাকৃতিক দৃশ্য, আর নানা ধরণের কার্টুন ছবি।
শিল্পী পরিচয়টা মুস্তফা মনোয়ার প্রথম পেয়েছিলেন আর্ট কলেজে শিক্ষা নিয়ে, ছবি এঁকে ও আর্ট কলেজে শিক্ষকতা করে। কিন্তু তাঁর জীবনের বাঁকে বাঁকে প্রথম থেকেই মিশে ছিল শিল্পকলার সকল শাখায় আরো অনেক কর্ম, কৌশল, রস ও ভাষা। এক সময় তিনি চমৎকার গান গাইতেন, ফটোগ্রাফি করতেন, ফুটবলও খেলতেন। আর এতসব কিছুর নেপথ্যের অন্যতম কারণ, মুস্তফা মনোয়ারের জন্ম হয়েছিল শিল্পী পরিবারে। তাঁর বাবা কবি গোলাম মোস্তফা ছিলেন ভীষণ শিল্পরসিক, তিনি শুধু কবিতা লিখতেন না, ভালো গানও গাইতেন, আর প্রায়ই গ্রামে বসাতেন গ্রামের গুণী গায়েনদের গানের আসর, আয়োজন করতেন লাঠিখেলা। তাই মুস্তফা মনোয়ার একেবারে বাল্যবয়স থেকেই গ্রাম্য সংস্কৃতির প্রেমে পড়ে যান।
ছাত্র অবস্থায় দার্জিলিং বেড়াতে যেয়ে দার্জিলিং এর প্রাকৃতিক দৃশ্যের ওপর জল রং-এর কতকগুলি ছবি এঁকে সকলকে তিনি অবাক করে দিয়েছিলেন। তৎকালীন ইউ. এস. আই. এস-এর পরিচালনায় তাঁর ছবিগুলির ওপর ঢাকায় এক প্রদর্শনী হয়। এ প্রদর্শনীই তাঁর শিল্পীজীবনের প্রথম স্বীকৃতি বয়ে আনে।
শিল্পী মুস্তফা মনোয়ার দেশে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলির পরিকল্পনা ও পরিচালনা করে বিশেষ কৃতিত্ব অর্জন করেছেন।
বাংলাদেশের চিত্রশিল্পে জলরঙের চর্চায় তাঁর অবদান অবশ্য স্বীকার্য তিনি জলরঙের স্বচ্ছতা রক্ষায় সিদ্ধহস্ত এবং মৌলিক নৈপুণ্যের অধিকারী। জলরঙ ছাড়াও তেলরঙ ও গ্রাফিক্সে শিল্পী মুস্তফা মনোয়ারের দক্ষতায় স্বীকৃতি মিলেছে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রদর্শনীতে।
সঙ্গীতের ভূবন :
কবিপিতা ও বড়ভাইয়ের কাছ থেকে সঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন। সঙ্গীতের শিক্ষায় তাঁর প্রথম রাগের নাম হচ্ছে জৈনপুরি। আর্ট কলেজে যখন পড়তে শুরু করেন তিনি তখন নতুন করে আবার সঙ্গীতশিক্ষার সূচনা করেন ওস্তাদ ফাইয়াজ খানের শিষ্য ওস্তাদ সন্তোষ রায়ের কাছে। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি তাঁর সুরেলা কণ্ঠের জন্যে খ্যাতিমান গায়ক হিসেবে সবার নিকট বিশেষ পরিচিতি হয়ে ওঠেন। বিশেষ করে এই সময়ে বঙ্গ সাংস্কৃতি সম্মেলনে পল্লীগীতি গেয়ে তিনি ব্যাপক সুখ্যাতি অর্জন করেন। পল্লীগীতি ছাড়াও তাঁর কণ্ঠে গীত ও গজলের অপূর্ব মাধুর্য ছিল। আর্ট কলেজে দ্বিতীয়বর্ষে পড়ার সময়ে তিনি ‘হিজ মাস্টার কম্পিটিশনে’ অংশ নিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে একক সঙ্গীত পরিবেশনার জন্য বশীর আহমেদ এবং সুবীর সেনের সঙ্গে যুগ্মভাবে সেরা গায়ক নির্বাচিত হন। প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী নির্মলেন্দু চৌধুরীর দলে দীর্ঘদিন সম্পৃক্ত থেকেছেন। পরে ছবি আঁকার ব্যস্ততার জন্য মুস্তফা মনোয়ারের আর গান গাওয়া হয়নি। কিন্তু সুর থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন নন কোনোদিনই। তাঁর পাপেট শিল্প সুর, কথা, গান, অভিনয়, চিত্রকলা, কবিতা সব শিল্পকেই ধরে আছে।
ছবি এঁকে জেলে গেলেন :
নারায়ণগঞ্জ স্কুলে নবম শ্রেণীতে পড়াকালীন তিনি বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের কথা শোনেন। ঢাকায় গুলি হয়েছে, বাঙালি শহীদ হয়েছে, পাকিস্তানিরা বাংলা ভাষা বন্ধ করে দিতে চায়। এই প্রেক্ষাপটে ছবি আঁকতে শুরু করেন এবং সেই ছবি বন্ধুদের সঙ্গে সারা নারায়ণগঞ্জ শহরের দেয়ালে দেয়ালে সেঁটে দেন। যার ফলে পুলিশ এসে তাঁর দুলাভাইসহ তাঁকে বন্দী করে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেয়। ভাষা আন্দোলনের সময়ের সেই কারাবাসের স্মৃতির মধ্যে তিনি সেখানকার কয়েদিদের কাছ থেকে কিশোর আন্দোলনকর্মী হিসেবে যে সমীহ পেয়েছিলেন, তা আজও ভুলতে পারেননি। ছাত্রনেতা শফি ভাই তাঁর স্মৃতিতে আজও ভাস্বর এক মাস কারাবাসের পর সে যাত্রার মুক্তি পান তিনি।
পাপেট উদ্ভাবনের কৃতিত্ব :
গ্রামবাংলার পুতুলনাচ ছোটবেলাতেই তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল। আর এখন তো বাংলাদেশের পাপেটচর্চার অন্যতম প্রাণপুরুষ তিনি। বাংলাদেশে পাপেট তৈরী ও কাহিনী সংবলিত পাপেট প্রদর্শনের তিনিই মূল উদ্যোক্তা। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের পাপেট তিনি প্রথম দেখেছিলেন কোলকাতা আর্ট কলেজে পড়তে গিয়ে। কোলকাতা আর্ট কলেজ থেকে পাস করে ঢাকা আর্ট কলেজে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে তিনি প্রথম পাপেট নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
মুস্তফা মনোয়ারের উল্লেখযোগ্য শৈল্পিক সৃষ্টি এই ‘পাপেট’। বাংলাদেশ থিয়েটার পাপেট এন্ড এনিমেশনের তিনি পরিকল্পক, গবেষক ও উদ্ভাবক। পাপেট নিয়ে বহুদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা তাঁর আছে। প্রথমবার তিনি তাঁর নিজের পাপেট দলসহ বাংলাদেশের ফোক পাপেট দল ধনমিয়াকে নিয়ে মস্কো ও তাশখন্দ সফর করেন। সেখানে বাংলাদেশের ফোক পাপেট ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করেন। বাংলাদেশ টেলিভিশন থেকে প্রচারিত তাঁর ‘পাপেট’ এর মাধ্যমে শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান ‘ক’ ও ‘খ’ জাপানে ও পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের টি. ভি অনুষ্ঠান প্রতিযোগিতায় পুরস্কার লাভ করে। ১৯৮২ সালে তিনি কলম্বোয় ‘এনিমেশন এন্ড পাপেট ফর টেলিভিশন’ বিষয়ক আনত্মজার্তিক সম্মেলনে বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। ঢাকায় জাতীয় স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত সাফ - গেমসের জন্যে তাঁর উদ্ভাবিত ‘মিশুক’ যা বৃহৎ আকারের চলমান পাপেটরূপে সকলের নিকট জনপ্রিয় ও অত্যন্ত প্রশংসনীয়। তাঁর উদ্ভাবিত পাপেট আন্তজার্তিক মানের। যার স্বীকৃতি স্বরূপ তিনিই একমাত্র ব্যক্তিত্ব যাকে ইউ. এন. আই. এম. এর সদস্যপদ প্রদান করা হয়।
১৯৬০-৬১ খ্রিষ্টাব্দের দিকে কলিম শরাফী তাঁর একটি ডকুমেন্টারিতে সর্বপ্রথম মুস্তফা মনোয়ারের পাপেটকে অন্তর্ভুক্ত করেন। টেলিভিশনে ‘আজব দেশে’ অনুষ্ঠানে নিয়মিতভাবে তিনি ‘বাঘা’ ও ‘মেনি’ চরিত্র রচনা করে পাপেট প্রদর্শনী করতে থাকেন। এটা ১৯৬৭-৬৮ সালের ঘটনা। তাঁর সে সময়ের কাহিনীতে পলিটিক্যাল স্যাটায়ার থাকত বেশী। টেলিভিশন পাপেটের সঙ্গে ছবি আঁকা শেখানো অনুষ্ঠানে তিনি পরিকল্পনা ও উপস্থাপক ছিলেন।
দ্বিতীয় সাব গেমসের মাশকট মিশুক (১০ ফুট হরিণ সাবক) এবং ষষ্ঠ সাফ গেমসের মাসকট অদম্য (বাঘরূপী জীবন্ত পাপেট) নির্মাণ তাঁর বড় একটি সাফল্য।
সাংস্কৃতি অঙ্গনের বিভিন্ন শাখায় বিচরণকারী মুস্তফা মনোয়ার স্বদেশের সাংস্কৃতিক ভাবমূর্তিকে মর্যাদার আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে এক দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে আজীবন দুর্গম পথ অতিক্রম করে চলেছেন। বর্তমানে তিনি এডুকেশন পাপেট ডেভেলপমেন্ট সেন্টার বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী পাপেট শিল্পকলা (পুতুল নাচ) এর বিকাশ ও সমপ্রসারণের উদ্দেশ্যে অব্যাহতভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
সম্মাননা:
১৯৫৭ সালে কলকাতায় একাডেমি অব ফাইন আর্টস আয়োজিত নিখিল ভারত চারু ও কারুকলা প্রদর্শনীতে গ্রাফিক্স শাখায় শ্রেষ্ঠ কর্মের স্বীকৃতিতে স্বর্ণপদক লাভ করেন। ১৯৫৮ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র চারুকলা প্রদর্শনীতে তেলচিত্র ও জলরঙ শাখার শ্রেষ্ঠ কর্মের জন্য দুটি স্বর্ণপদক পান। ১৯৯০ সালে টিভি নাটকের ক্ষেত্রে অবদানের জন্য টেনাশিনাস পদক লাভ করেন। চিত্রশিল্প, নাট্য নির্দেশক এবং পাপেট নির্মাণে অবদানের জন্য শিশু কেন্দ্র থেকে ২০০২ সালে বিশেষ সম্মাননা লাভ করেন। চারুকলার গৌরবময় অবদান ও কীর্তির স্বীকৃতি স্বরূপ ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের একুশে পদকে ভূষিত হন তিনি।
বিদেশ ভ্রমণ:
মুসত্মফা মনোয়ার পেশাগত যোগ্যতা বৃদ্ধি ও প্রতিভা বিকাশের জন্যে জাপান, সোভিয়েত ইউনিয়ন, শ্রীলংকায় প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়াও তিনি সরকারী সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিদলের উপনেতা হিসেবে হংকং, থাইল্যান্ড এবং দলনেতা হিসেবে উত্তর কোরিয়া ও চীন সফর করেন।
ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ:
প্রতিবাদী শিল্পী মুস্তফা মনোয়ার, ভাষা আন্দোলনসহ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন। নারায়ণগঞ্জ সরকারী হাইস্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র তখন তিনি ভাষা আন্দোলনে যোগ দিয়ে ভাষা আন্দোলনের স্বপক্ষে বিভিন্ন ধরণের পোস্টার এঁকে নারায়ণগঞ্জবাসীকে অবাক করে দিয়েছিলেন। এর পুরস্কার স্বরূপ তিনি পেয়েছিলেন পাকিস্তান সরকারের জেল যন্ত্রণা।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি ভারতে অবস্থানকালীন বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ প্রবাসী সরকারের সাংস্কৃতিক দলের নেতৃত্ব প্রদান করেন এবং স্বাধীনতার স্বপক্ষে জনমত গঠনের লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচী পরিচালনা করেন।
তথ্য সূত্র :
যশোরের যশস্বী, শিল্পী ও সাহিত্যিক
লেখক : কাজী শওকত শাহী
ও
প্রথম আলো ছুটিরদিনে
সম্পাদনা :
মোঃ হাসানূজ্জামান বিপুল
সর্বশেষ আপডেট :
মার্চ ২০১২