
Home রাজনীতিবিদ / Politicians > সৈয়দ নওশের আলী / Syed Nawsher Ali (1891-1972)
এই পৃষ্ঠাটি মোট 100052 বার পড়া হয়েছে
সৈয়দ নওশের আলী / Syed Nawsher Ali (1891-1972)
সৈয়দ নওশের আলী
Syed Nawsher Ali
Narail
Syed Nawsher Ali
Narail

ব্রিটিশ-ভারতের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ সৈয়দ নওশের আলী ছিলেন জীবন্ত কিংবদন্তী ও যশোর জাগরণের অগ্রদূত। তাঁর পরে নড়াইল জেলায় আর কেউ মন্ত্রী হননি। তাঁর বাগ্মীতায় ছিল সম্মোহনী শক্তি। প্রখ্যাত এই রাজনীতিবিদ যশোরের নড়াইল জেলার নড়াইল মহকুমার (বর্তমান জেলা) মির্জাপুর গ্রামে ১৮৯১ খৃষ্টাব্দে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সৈয়দ ওমেদ আলী এবং মাতার নাম নসিমন নেছা। তিনি অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের সময় তাদের ভিটাবাড়ী ও কয়েক বিঘা কৃষি জমি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। দরিদ্র হলেও সৈয়দ পরিবারের খ্যাতি কম ছিল না। জনাব সৈয়দ ওমেদ আলী কর্মজীবনে ফৌজদারী আদালতে সামান্য বেতনে কাজ করতেন বটে তবে সে সময়ের এম. ভি ও ইংরেজী পাশ করা লোক বলতে গ্রামের মধ্যে তিনিই প্রথম। তাঁর ভাই বোনদের কয়েকজন শৈশবেই মারা যায়। শেষ পর্যন্ত তাঁর ছোট দুই বোন বেঁচে থাকে।
১৯১৩ সালে তিনি লুৎফুন্নেসার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি চার পুত্র (সৈয়দ মাহমুদ জিলানী, সৈয়দ মনসুর জিলানী, সৈয়দ মাসুদ জিলানী ও সৈয়দ আবু আলী জিলানী রেজা) এবং চার কন্যা (কনিজ ফাতেমা মাহমুদা, কনিজ ফাতেমা মোহসিনা বেবী, কনিজ ফাতেমা মজিবা রুবি ও কনিজ ফাতেমা মাসুদা হাওয়া) সন্তানের জনক।
প্রয়াত সৈয়দ মুনসুর জিলানী রাজনীতিবিদ ছিলেন। ভারত কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য এবং জাহাজী শ্রমিকদের একসময় খুবই জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। ছোট মেয়ে কনিজ ফাতেমা মাসুদা ভারতের আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপিকা ছিলেন। তার বড় নাতনি ডাঃ আয়েশা চৌধুরী ডোরা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় শাহাদৎ বরণ করেন। ডাঃ আয়েশা চৌধুরী ডোরা কনিজ ফাতেমা মাহমুদার কন্যা। তার দুই নাতি হায়দার আকবর খান রণো ও হায়দার আনোয়ার খান জুনো বাংলাদেশের বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। তারা কনিজ ফাতেমা মুহসিনার পুত্র।
শিক্ষাজীবন :
সৈয়দ ওমেদ আলীর প্রত্যাশা ছিল ছেলে লেখাপড়া করে মানুষ হয়ে উঠুক। পিতৃ আশির্বাদ মাথায় নিয়ে বালক নওশের আলীর পড়াশুনা শুরু হয় নিজ গ্রামের এম.ই স্কুলে। স্কুলে পড়ার সময় তাঁর পিতৃবিয়োগ ঘটে। পিতৃবিয়োগের পরে বুদ্ধিমতি মায়ের প্রভাব পড়ে তাঁর জীবনে। দরিদ্র ও ভগ্নস্বাস্থ্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেই সারাটা ছাত্রজীবন তাঁকে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে হয়। তাঁর অসাধারণ চেষ্টা এবং অদম্য মনোবল তাঁকে সহায়তা করে। গ্রামের স্কুলে তিনি বৃত্তি পেতেন। খুলনা দৌলতপুর হাইস্কুলের (বর্তমান মোহসিন মাধ্যমিক স্কুলে) ভর্তি করা হয় তাঁকে এবং এখান থেকে ১৯০৯ সালে কৃতিত্ত্বের সাথে এন্ট্রান্স পাশ করেন (এটাই শেষ এন্ট্রান্স পরীক্ষা, এরপর ১৯১০ সালের পর থেকে পরীক্ষার নাম হয় ‘ম্যাট্রিক’)। লেখাপড়ার জন্য অশেষ বুদ্ধিমতি মায়ের প্রচেষ্টাও বিশেষ অবদান রাখে। সৈয়দ নওশের আলী তাঁর চরিত্র গঠনের প্রভাব সম্পর্কে নিজে বলতেন যে, ‘তাঁর মা, চিত্রা নদীর পাড়ের প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশ তাঁর চরিত্রের উপর বিশেষ প্রভাব ফেলে’।
গ্রামের স্কুল থেকে এম, ই পরীক্ষা দিয়ে নওশের আলী বৃত্তি পান এবং সেটি সম্বল করে খুলনার দৌলতপুর হাইস্কুলে ভর্তি হন। এসময়ে মোহসিন ফান্ডের বৃত্তি না পেলে তাঁর পক্ষে লেখাপড়া করা সম্ভব হতো না। ১৯০৯ সালে এখান থেকে বৃত্তিসহ এন্ট্রান্স পাশ করেন। এন্ট্রান্স পাশ করার পর দৌলতপুর কলেজে (পরবর্তী বি. এল কলেজ) আর্টস নিয়ে পড়াশুনা করেন। তৎকালীন সময়ে এখানে মুসলিম ছাত্রকে ভর্তি করা হতো না। সৈয়দ নওশের আলী এবং আটরা গিলাতলা নিবাসী মোঃ একরামউদ্দীনই প্রথম মুসলিম ছাত্র। যারা বি. এল কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ লাভ করেন। নওশের আলী আড়ংঘাটা ও শিরোমনির নিকট কাঁঠালবাড়ী গ্রামে লজিং থেকে পড়াশুনা করতেন। মেধাবী ছাত্র হিসেবে সকলে তাঁকে সুনজরে দেখতেন। আই. এ পরীক্ষাতে তিনি যথারীতি মাসিক ১২ টাকা বৃত্তিসহ পাশ করেন। এই সময়কার অবস্থা সম্পর্কে তিনি নিজে বলেছেন, “এ সময় কখনো পরের বাড়ীতে জায়গীর থেকে আবার কখনোবা গোয়াল ঘরের মধ্যে স্থান করে নিয়ে লেখাপড়া চালিয়ে গেছি।” বৃত্তিসহ পাশ করলে গোড়া হিন্দু ব্যক্তিবর্গ খুশি হতে পারেননি। এখানে মুসলমান ছাত্র ভর্তি করা হতো না। ভর্তি হওয়ার পর পরই বৃত্তি নিয়ে পাশ করায় বিস্ময়ের উদ্রেক প্রকাশ করলো হিন্দু সমাজ। কিন্তু নওশের আলী বৃত্তিলাভের বিষয়টি মুসলমান ছাত্রদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎসাহ হয়ে দাঁড়ালো। খুলনার পরে তিনি কলকাতায় চলে আসেন এবং ১৯১৩ সালে কলকাতা সিটি কলেজ থেকে দর্শন শাস্ত্রে অনার্সসহ বি. এ পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হন। ঐ সময় তিনি বেগম লুৎফুন্নেছার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ল’ কলেজ থেকে সাফল্যের সাথে আইন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
তাঁর ছাত্রজীবনের লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তিনি যেটুকু জানতেন বা পড়তেন তা অতিশয় গভীর মনোযোগ সহকারে। তাঁর শিক্ষকবৃন্দ তাঁর সাধারণ জ্ঞান ও মনন শক্তিতে মুগ্ধ ছিলেন। বাল্যকাল থেকেই জনাব নওশের আলী অত্যন্ত নির্ভীক ও স্পষ্টবাদী ছিলেন। সত্য মিথ্যার বিষয়টি ব্যক্ত করতে দ্বিধা করতেন না। তিনি জীবনের সর্বক্ষেত্রে নির্ভীকতার ছাপ রেখেছেন।
পেশাগত জীবন:
সৈয়দ নওশের আলীর বৈচিত্র্যময় কর্মজীবনের সূত্রপাত হয় ১৯২২ সালে। ১৯২২ সালে কোলকাতা হাইকোর্টের এ্যাডভোকেট হিসেবে পেশাগতজীবন শুরু করেন। অসাধারণ বুদ্ধি ও প্রত্যুৎপন্ন মেধার কারণে তিনি আইনজীবী হিসেবে অত্যন্ত দ্রুত খ্যাতি লাভ করেন। পরবর্তীতে সুপ্রীম কোর্টের এ্যাডভোকেট এবং কোলকাতা হাইকোর্টের বার এ্যসোসিয়েশনের সভাপতি হয়েছিলেন। উল্লেখ্য যে, কর্মজীবনের গোড়াতে তিনি খুলনা দৌলতপুরের মোহসিন স্কুলের শিক্ষক হিসেবে কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেন।
রাজনৈতিক জীবন :
ইত্যবসরে জন্মভূমির সেবার জরুরী আহ্বান আসে সৈয়দ নওশের আলীর কাছে। জেলাবাসীর অকুন্ঠ সমর্থনে প্রথমে যশোর জেলা বোর্ডের সদস্য ও পরে ১৯২৮ সালে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে জনগণের কল্যাণমূলক কর্মে নিয়োজিত হন। ইংরেজ প্রশাসন ও স্থানীয় কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী তাঁকে যে কি পরিমাণে ভয় পেতো তা মাসিক বসুমতী পত্রিকা মারফত জানা যায়। জেলা বোর্ডটি যাতে সত্যি সত্যি জনগণের কল্যাণে নিয়োজিত হতে পারে তার জন্য তাঁর প্রয়াসের অন্ত ছিল না। বহু প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয় তাঁকে এই সময়ে। কিন্তু তাঁর জন্য কর্তব্য নিষ্ঠায় পিছ-পা হয়ে আসেননি তিনি।
আবুল কাশেম ফজলুল হকের প্রথম মন্ত্রীসভার অন্যতম সদস্য ছিলেন সৈয়দ নওশের আলী। সব সময় তিনি অবিভক্ত ভারতের সমর্থক ছিলেন। তিনি সমাজসেবক, দেশ দরদী এবং অনুন্নত মুসলিম সমাজের সর্বপ্রথম বৃহত্তর যশোরের রাজনৈতিক দিশারী ও পথপ্রদর্শক ছিলেন। তিনি একজন বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ এবং যশোর জেলার মুসলমানদের সর্বপ্রথম রাজনীতির গোড়াপত্তন করেন। বাংলায় যে অল্প কয়েকজন রাজনীতিবিদ বিশ্বাস করতেন যে, বাঙ্গালী মুসলমানদের মুক্তি হিন্দু-মুসলিম সহযোগিতা এবং বৃটিশদের বিরুদ্ধে সর্বাত্নক আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়োজন তিনি তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। ১৯৪০ এর দশকে যখন অভিজাত মুসলিম রাজনীতিবিদদের প্রায়ই সবাই পাকিস্তান আন্দোলনে সমর্থক হয়ে উঠেছিলেন তখন একমাত্র নওশের আলী কংগ্রেসে যোগ দেন এবং ভারতের স্বাধীনতার পরে ভারতে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
জন্মস্থান নড়াইলে কৃষক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সৈয়দ নওশের আলীর রাজনৈতিক জীবনের শুরু। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। পাক-ভারত স্বাধীনতার পরে তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কমিউনিটি শিবিরের সঙ্গে থেকেছেন। এর পাশাপাশি তিনি পর্যায়ক্রমে বঙ্গীয় ফজলুল হকের মন্ত্রিসভার মন্ত্রী (১৯৩৭), অবিভক্ত বাংলার আইনসভার স্পীকার ও স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ভারতের প্রভিশনাল পার্লামেন্টের সদস্য, পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা ও ভারতের কেন্দ্রের রাজ্যসভার সদস্য হিসাবে বিভিন্ন সময়ে বহুল আলোচিত ও বিতর্ক উত্তর ভূমিকা নিয়ে রাজনীতিতে সক্রিয়তার সাক্ষর রেখে স্মরণীয় হয়েছেন।
একসময় তিনি অনুধাবন করেন যে, ভাগচাষী ও অন্যান্য গরীব শ্রেণীর উপর নিপীড়নের বিরুদ্ধে, বিশেষতঃ জমিদারী প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা প্রয়োজন। নড়াইল অঞ্চলে ৩০ এর দশকে তিনি তে-ভাগা সংগ্রাম শুরু করেন। ১৯৪৬ সালে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে যে তে-ভাগা আন্দোলন গড়ে ওঠে তার অন্যতম সংগঠক ও বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সাবেক সভাপতি বর্ষীয়ান নেতা কমরেড অমল সেন “নড়াইলের তে-ভাগা আন্দোলনের সমীক্ষা” নামক পু্স্তিকাতে সৈয়দ নওশের আলীর ভূমিকার কথা উল্লেখ করে বলেন যে, “১৯৪০ সাল পর্যন্ত প্রায় এক দশক ধরে সৈয়দ নওশের আলী ছিলেন যশোর জেলার মুসলমান ও নমঃশূদ্র কৃষকের মুকুটহীন রাজা। আইনসভা, জেলা বোর্ড ও ইউনিয়ন বোর্ড প্রভৃতি যে কোন নির্বাচনে সৈয়দ নওশের আলী কলাগাছ প্রার্থী মনোনীত করলেও তাকে কারো পক্ষে মোকাবেলা করার অবস্থা ছিল না। সৈয়দ নওশের আলী কখনও মুসলিম লীগ করেননি।
যশোর জেলায় তিনি যখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে তখন স্যার নাজিমউদ্দীন তাঁকে মুসলিম লীগে যোগদান করার অনুরোধ করলে তিনি মুসলিম লীগকে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের পক্ষের দল বিবেচনা করে এ অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯২৯ সালে সৈয়দ নওশের আলী বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ইতোমধ্যে তাঁর সাথে বাংলার বাঘ আবুল কাসেম ফজলুল হক সাহেবের সাথে যোগাযোগ হয় এবং তিনি ধারণা করেছিলেন যে, তাঁর দল কৃষক প্রজা পার্টির গরীব কৃষক জনসাধারণের পক্ষে কাজ করবেন। তিনি এ দলে যোগদান করেন এবং দলের অন্যতম অগ্রণী কর্মঠ নেতা হয়ে ওঠেন।
১৯৩৭ সালে বাংলার প্রথম সাধারণ নির্বাচন হয়। ফজলুর হকের প্রধানমন্ত্রীত্বে যে ১১ জনের মন্ত্রীসভা গঠিত হয় (বাংলার ইতিহাসে প্রথম নির্বাচিত মন্ত্রীসভা) সৈয়দ নওশের আলী ছিলেন তার অন্যতম সদস্য। এই মন্ত্রীসভায় সৈয়দ নওশের আলীসহ মাত্র ২জন ভূ-স্বামী শ্রেণীর বাইরের ব্যক্তি ছিলেন। বয়সের দিক থেকে সৈয়দ নওশের আলী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রীদের মধ্যে কনিষ্ঠতম ছিলেন। সৈয়দ নওশের আলী ছিলেন স্বাস্থ্য ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। মাত্র দেড় বৎসরের মাথায় তিনি মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। কারণ তিনি রাজবন্দীর মুক্তি ও জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের দাবী তোলেন এবং তা নিয়ে মন্ত্রীসভায় মত বিরোধের কারণে তিনি মন্ত্রীত্ব ত্যাগ করেন।
১৯৪১ সালে সৈয়দ নওশের আলী Bengal Progressive Coalition Party (Congress and K.S.P) তে যোগদান করেন (শেরেবাংলার নেতৃত্বে)। কেননা সেসময়ে তিনি বুঝেছিলেন যে, কংগ্রেস বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরম্নদ্ধে সংগ্রাম করছে। সেসময় থেকে নেতাজী সুভাস বোসের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ও হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। এমনকি নেতাজীর দেশত্যাগের পরিকল্পনার সঙ্গে তিনিও কিছুটা জড়িত ছিলেন বলে শোনা যায়।
একই সময়ে সৈয়দ নওশের আলী গোপন সশস্ত্রবাদী জাতীয়তাবাদী বিপ্লবীদের সাথে গোপন যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন। বৃটিশ বিরোধী বক্তৃতা করার অপরাধে ১৯৪২ সালে তাঁকে কারাবরণ করতে হয়েছিল। ভারতের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সাবেক সম্পাদক প্রয়াত সরোজ মুখোপাধ্যায়ের ‘ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ও আমরা’ নামক গ্রন্থের বর্ণনায় জানা যায় যে, তিরিশের দশকে যে কয়েকটি জায়গাকে কেন্দ্র করে কংগ্রেস সোস্যালিস্ট শ্রমিক-কৃষক ও বিপ্লববাদী আন্দোলন ও অন্যান্য রাজনীতির বিভিন্ন ধারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হতো কলকাতার বৈঠকখানার রোডস্থ নওশের আলীর বাড়িটি ছিল তার কেন্দ্রবিন্দু। চল্লিশের দশকে সৈয়দ নওশের আলী সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটি, বেঙ্গল প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি ও বেঙ্গল কংগ্রেস ইলেকশন কমিটি (১৯৪৫) এর সদস্য ছিলেন। এসময়েই তাঁর সাথে কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দে ঘনিষ্ঠতা জন্মায়। দুর্ভিক্ষের সময় কমিউনিস্ট পার্টি পিপলস্ রিলিফ কমিটি গঠন করলে তিনি প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। কোলকাতার বউবাজার স্ট্রীটে এই পিপলস্ রিলিফ কমিটির অফিস রয়েছে।
১৯৪৩ সালে সৈয়দ নওশের আলী বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার স্পীকার নির্বাচিত হন। জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান, প্রাদেশিক মন্ত্রী ও আইন সভার স্পীকার হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেও তিনি ব্যক্তিত্ব ও স্বকীয়তার স্বাক্ষর রেখেছেন। বিংশ শতাব্দীর চার দশকে তিনি একজন প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ। কৃষকের বন্ধু জনাব আলী সম্পর্কে ফয়েজ আহমেদ ‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী’ নামক গ্রন্থে বলেছেন “প্রায় দশ বছরকাল নিপীড়িত ও দরিদ্র কৃষকদের অসাধারণ জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশে সামপ্রদায়িক মুসলিম লীগ বিরোধী এই নেতা কৃষক সমিতি গঠন করে নড়াইল অঞ্চলে দীর্ঘদিন ব্যাপী কৃষকদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছেন। এই অঞ্চলেই পার্টি থেকে নির্দেশিত অমল সেন (ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা) ১৯৩৫ সাল থেকে ’৪৬ সাল পর্যন্ত সমিতির মাধ্যমে যে কৃষক আন্দোলন করেছিলেন, শেষ পর্যন্ত তে-ভাগা আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায়।” তিনি সংগ্রামী কৃষকদের তে-ভাগা আন্দোলনে জড়িত ছিলেন। তিনি নড়াইলের কয়েকটি গ্রামের কৃষকদের তে-ভাগা আন্দোলন সম্পর্কে সচেতন কৃষকদের মুক্তির সন্ধান দেন।
সৈয়দ নওশের আলী ১৯৪৫ সালের ২৯ মার্চ বঙ্গীয় আইন সভার স্পীকার হিসেবে যে রুলিং দিয়েছিলেন তা সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সেসময়ে নাজিমউদ্দীনের নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগের মন্ত্রীসভা ছিল বাংলায়। ১৯৪৫ এর ২৮ মার্চ কৃষি বাজেট ১০৬-৯৭ ভোটে হেরে যায়। এই ঘটনার পরদিন হাউজে উত্তেজনা ও উদ্বেগ বিরাজমান ছিল। স্পীকার সৈয়দ নওশের আলী সভাকক্ষে প্রবেশ করতেই সকলের দৃষ্টি তাঁর উপর পড়লো। পড়তে লাগলেন তাঁর রুলিং যার উপর নির্ভর করছে নাজিমউদ্দীন-সোহরাওয়ার্দী লালিত লীগ মন্ত্রীসভার অস্তিত্ব। ঐ দিন কৃষিমন্ত্রী মোয়াজ্জেমউদ্দীন খাঁ বাজেটের কৃষিখাতে ব্যয় বরাদ্দের দাবী করলে বিরোধী পক্ষের ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত একটি ছাটাই প্রস্তাব উত্থাপন করেন। প্রস্তাবের পক্ষে ১০৭ এবং বিপক্ষে ৯৭ ভোট পড়ে। সরকার পক্ষের পরাজয় হয়। তাই এ পক্ষের ধুরন্ধর সদস্যগণ নানা যুক্তি জাল দেখাতে চেষ্টা করে। স্পীকার নওশের আলী উভয়পক্ষের বক্তব্য শুনে সভা মুলতবী রাখেন। এই পটভূমিতে ২৯ মার্চ হাউজ বসে। সৈয়দ নওশের আলী প্রসঙ্গ উল্লেখপূর্বক বলেন, “কৃষিখাতের উপর ব্যয় বরাদ্দের দাবী ছাটাই প্রস্তাবের মাধ্যমে হাউজ নাকোচ করে দেওয়ায় তার ফলাফল কি হতে পারে? সেটাই হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। সাধারণ ব্যাপার হলে আমি বিলম্ব করতে পারতাম। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমি এখানে এবং এখনি আমার সিদ্ধান্ত দিতে বাধ্য।” দৃঢ়কণ্ঠে তিনি ইংরেজীতে বক্তৃতা রাখেন। সোহরাওয়ার্দীর আপত্তিতে ভ্রূক্ষেপ না করে তিনি বলেন, “মন্ত্রীমন্ডলী এ পরিষদেরই সৃষ্টি। এ হাউজই কোন মন্ত্রীসভাকে গঠন বা ভেঙ্গে দিতে পারে। আর গভর্ণর পরিষদের ওই রূপ সিদ্ধান্ত নথিভূক্ত করার কর্তা মাত্র। '(It is the House which makes and unmakes a Ministry and the Governor is only a registering authority)' সরাসরি অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন ছাড়াও সরকারের বিরুদ্ধে অবলম্বন করার মত অন্যান্য স্বীকৃত পদ্ধতি আছে। স্যার নাজিমউদ্দীন দাবী করতে পারেন সরকারের বিরুদ্ধে এই আচমকা ভোটের দ্বারা হাউজের অধিকাংশের মতামত প্রতিফলিত হতে পারে না। কিন্তু মন্ত্রীমন্ডলীর বিরুদ্ধে যে রায় দিয়েছেন তারপর একে চালিয়ে যেতে দেয়া সমিচীন হবে বলে তিনি মনে করেন না। এ অবস্থায় আমার মনে হয়, একটি নতুন মন্ত্রীসভা গঠন না হওয়া পর্যন্ত এ হাউজ আর এক মুহূর্ত চলতে পারে না।”
এ রুলিং দিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য হাউজ মুলতবী ঘোষণা করে স্পীকার সৈয়দ নওশের আলী কক্ষ ত্যাগ করেন। সরকারী বেঞ্চ এর সদস্যদের মুখে চুনকালি, অপরপক্ষে বিরোধী পক্ষের আনন্দের সীমা নেই। ১৯৪৩-এ ইংরেজ মুসলিম ষড়যন্ত্রের বলি ফজলুল হক সেসময় বিরোধী দলের নেতা। ঠিক দু’বছর পর ১৯৪৫-এ মুসলিম লীগ পরিচালিত মন্ত্রীসভার এই পরিণতিতে তাঁর চোখে-মুখে প্রচন্ড তৃপ্তির চিহ্ন। আরো বললেন, “নিপাত যাও তোমরা।”
সৈয়দ নওশের আলী নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসুর নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনী (আজদ-হিন্দ-ফৌজ) এর চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি ১৯৪৭ সালের পাকিস্তনের সৃষ্টিকে মনে-প্রাণে মেনে নিতে পারেননি। এ কারণেই তিনি ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ভারতেই থেকে যান। "He opted to remain in West Bengal on the partition of the Sub-continent in 1947 as he opposed the Pakistan scheme." সব সময় তিনি পাকিস্তান পরিকল্পনার বিরোধিতা করেন। তিনি কিছুকাল ভারতীয় কয়লা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৫০-১৯৫২ পর্যন্ত ভারতীয় Provisional Parliament ১৯৫২-১৯৫৬ সাল পর্যন্ত এবং ১৯৬২-১৯৬৮ সাল পর্যন্ত ভারতীয় পার্লামেন্টের সদস্য ছিলেন। ১৯৫৭-১৯৬২ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের আইনসভার সদস্য ছিলেন।
সেবামূলক কর্মকান্ড :
স্বল্পকালীন মন্ত্রীত্বের সময় তিনি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে গেছেন, যা সেদিনের প্রেক্ষাপটে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সেসময়ে মুসলমানেরা সবদিক হতে পিছিয়ে ছিল। সৈয়দ নওশের আলী আগাগোড়া অসাম্প্রদায়িক হওয়া সত্ত্বেও স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে বেশ কিছু প্রতিভাবান মুসলমান ছাত্রকে বিদেশে উচ্চতর মেডিকেল শিক্ষার ও উচ্চপদে অবস্থানের সুযোগ করে দেন। ডাঃ এ. কিউ বদিউর রহমান তাঁর "স্বদেশ-বিদেশ" নামক গ্রন্থে লিখেছেন “জনাব নওশের আলী নামে একজন বিখ্যাত সাহসী মন্ত্রী ছিলেন। মেডিকেল কলেজে ১০০ জন নতুন ছাত্রের মধ্যে মাত্র ১/২ জন মুসলমান ছাত্র ভর্তি হতে পারতো। তিনি এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে ১৯৪৫ সালের মধ্যে কোলকাতা মেডিকেল কলেজে মুসলমান ছাত্রের সংখ্যা ৫০% হতে হবে বলে ঘোষণা দেন। তাই আমরা মুসলমান ছাত্ররা ডাক্তার হতে পেরেছিলাম। তিনিই প্রথম একজন মুসলমানকে (মেজর ডাক্তার দবিরউদ্দীন আহমদ) মেডিকেল কলেজে প্রিন্সিপ্যাল হিসেবে নিয়োগ দেন। তিনিই প্রথম একজন ভারতীয়কে (ডাক্তার মনি দে) প্রফেসর অব মেডিসিন পদেও নিয়োগ প্রদান করেন। ইতোপূর্বে এই পদে সব সময় ইংরেজরা এই নিয়োগ নিয়ে তাঁর সঙ্গে ইংরেজ গভর্ণরের বিরোধ হলেও তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে তাঁর সাহসী ভূমিকা ও জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় পাওয়া যায়।
মন্ত্রীত্ব ত্যাগ :
নওশের আলীর মন্ত্রীত্ব ছিল স্বল্পস্থায়ী। কারণ অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর সঙ্গে মন্ত্রীসভার জমিদার মন্ত্রীদের গোষ্ঠীস্বার্থে বিরোধ সৃষ্টি হয়। বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে যৌথ নির্বাচন (অর্থাৎ ধর্মীয় সমপ্রদায় ভিত্তিতে পৃথক নির্বাচন নয়) এবং রাজবন্দীদের মুক্তির প্রশ্নে তিনি সোচ্চার হলে মন্ত্রীসভার অন্যান্যরা তাতে রাজী হননি। এমতাবস্থায় তিনি মাত্র দেড় বছরের মাথায় (২২ জুন ১৯৩৮) মন্ত্রীত্ব থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। মন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগের ঘটনা এই প্রথম। এই নাটকীয় ঘটনার পর তাঁর উপর প্রভাবশালী মহল থেকে নানা ধরণের চাপ আসে পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারের জন্য, কারণ এ ঘটনার রাজনৈতিক তাৎপর্য ছিল বিরল। কিন্তু নওশের আলী তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থাকেন।”
সৈয়দ নওশের আলীর পদত্যাগের পর নিখিল বঙ্গ কৃষক প্রজা সমিতির মুখপত্র হিসেবে প্রচারিক সাপ্তাহিক “কৃষক” পত্রিকায় সৈয়দ নওশের আলীর পদত্যাগের উপর এক বিশাল সম্পাদকীয় এবং প্রধানমন্ত্রীর এ. কে ফজলুল হক ও সৈয়দ নওশের আলীর মধ্যে যে পত্র বিনিময় হয় তা ছাপা হয়েছিল। সাপ্তাহিক ‘কৃষক’ এর ১৩৪৫ প্রথম বর্ষ ১৬ আষাঢ় ২১ সংখ্যার সম্পাদকীয়তে বলা হয় যে, সৈয়দ নওশের আলী জমিদার প্রভাবাধীন মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন কৃষকের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার জন্য। এই সম্পাদকীয়তে আরো বলা হয় যে, “একথা সকলে অবগত আছেন যে, বিগত ২৮ মার্চ তারিখে মৌলভী নওশের আলী সাহেব পদত্যাগ করিতে না চাহিলে প্রজাস্বত্ব আইন সালামী প্রথা রদসহ আইনসভায় পাস হতে পারতো না। ভূমি রাজস্ব কমিশন সন্বন্ধও তিনি প্রতিক্রিয়াশীল মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে যথাসাধ্য লড়াই করেছেন।” সম্পাদকীয়ের শেষ অংশে সৈয়দ নওশের আলীর মন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, “বাংলাদেশে ইংরেজ রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর হইতে আজ পর্যন্ত কোন মুসলমানই প্রতিশ্রুতির মর্যাদা রক্ষা সত্যনিষ্ঠা, দেশের স্বার্থ ও আত্মসম্মানের জন্য বিবেকের প্রেরণায় মাসিক আড়াই হাজার টাকা বেতনের মন্ত্রীত্বের ন্যায় গৌরবের পদ থেকে পদত্যাগ পূর্বক ত্যাগের এত বড় আদর্শ দেখাইতে পারেন নাই। জাতির মধ্যে কিছুমাত্র প্রাণের সঞ্চার অবশিষ্ট থাকিলে এই ঘটনায় সমগ্র জাতি চৈতন্য লাভ করিতে পারিত। ইহাতে বিধাতার কল্যাণ বর্ষিত স্বর্গীয় সম্পদ জ্ঞানে আকড়িয়া ধরিয়া মৃতপ্রায় জাতি নবজীবন লাভ করিয়া ধন্য হইত। কিন্তু তাহাকেই সুবধাবাদী, ভাগ্যান্বেষী, স্বার্থান্ধ লোকেরা অভিসম্পাতরূপে চিত্রিত করিতে প্রয়াস পাইতেছে।
কিন্তু এতদসত্বেও নওশের আলীর এই ত্যাগ বৃথা যাইবার নহে, যে দরিদ্র সাধারণের প্রতি কর্তব্য ও মমত্ব বৃদ্ধির প্রেরণায় তিনি এই বিরাট ত্যাগ স্বীকার করিয়াছেন তাহারা সত্য সত্যই ইহাকে আল্লার আশির্বাদস্বরূপ গ্রহণ করিয়া নতুন জীবন ও নতুন পথ লাভ করিবে এবং যে সকল ধাপ্পাবাজ ব্যক্তি ও দলগত হীনস্বার্থ সিদ্ধির উদ্দেশ্যে ইহাকে কু-অভিসন্ধি আরোপ করিতে চেষ্টা করিতেছেন। তাহাদিগকে অচিরেই সমাজের আবর্জনা স্বরূপ ঝাটাইয়া ময়লাস্তুপে নিক্ষেপ করিবে।”
পরাধীন ভারতের অবিভক্ত বাংলার কিংবদন্তীর রাজনৈতিক নেতা সৈয়দ নওশের আলী বৈচিত্র্যময় ও বর্ণাঢ্য রাজনৈতিকজীবনের অধিকারী ছিলেন। কোলকাতা থেকে প্রকাশিত মাসিক ‘বসুমতী’র ১৩৬৬ কার্তিক সংখ্যায় তাঁর সম্পর্কে বলা হয়েছিল “খাঁটী জাতীয়তাবাদী ও সংগ্রামী পুরুষ বলতে যা বোঝায়, ইনি হচ্ছেন তাই। একটি বৈশিষ্ট্যময় আদর্শজীবন যে জীবনের মূল দাবী হচ্ছে মানুষে মানুষে ভেদ করলে চলবে না। নিচে যে রয়েছে টেনে তুলতে হবে তাকে উপরে। এই উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও মতবাদই সৈয়দ নওশের আলীর জনপ্রিয়তার জন্য প্রধানতঃ দায়ী, এ নিশ্চয়।”
পরলোকগমন :
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনের পরে তিনি বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৭২ সালের ৬ এপ্রিল তিনি ৮০ বছর বয়সে ঢাকার পিজি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুতে ভারতীয় লোকসভায় গভীর শোক প্রকাশ করা হয়। স্পীকার শ্রী জি, এস ধীলন বলেন, “তিনি ছিলেন সার্থক পার্লামেন্টারিয়ান, স্পীকার হিসেবে সম্পূর্ণ পক্ষপাতহীন।’ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, “আলী ছিলেন একজন দক্ষ রাজনৈতিক কর্মী, প্রাণশক্তি ও উৎসাহ ছিল অসীম।” শ্রী সমর মুখার্জী (C.P.M), শ্রী ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত (C.P.I) বলেন, “আলী ছিলেন মহান জাতীয়তাবাদী ও প্রগতিশীল মুসলমান।” শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী বলেন,“সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে নওশের আলী পাকিস্তানের সৃষ্টি সমর্থন করতে পারেননি।” সেসময় তাঁর মৃত্যুতে ভারতীয় লোকসভা ও রাজ্যসভায় শোক প্রস্তাব গৃহিত হয় এবং উভয় সংসদের সভায় একদিনের জন্য মুলতবী হয়ে যায়। বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবু সাইয়িদ চৌধুরী, উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ বহু রাজনীতিবিদ এ নেতার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেন এবং জানাযায় শরিক হন।
অপূর্ণ ইচ্ছা :
সৈয়দ নওশের আলী সুদীর্ঘ রাজনৈতিকজীবনের শেষ অধ্যায়ে গভীর অন্তর্দ্বন্দ্বে ভুগেছেন। রাজ্যসভার সদস্য থাকাকালীন ০৬/০৯/১৯৬৩-তে নয়াদিল্লী থেকে নড়াইলের মির্জাপুরে তাঁর ভাগ্নে মোঃ মোজাম্মেল হোসেনের নিকট লিখিত পত্রের ভাষা তাঁর অন্তর্দ্বন্দ্বের সাক্ষ্য বহন করে। পত্রের ভাষা এখানে উল্লেখ্য : “আমার জীবনের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে গেছে। ইচ্ছা ছিল ও চেষ্টা ছিল যাতে ইন্ডিয়া ও পাকিস্তানের মানুষ সুখে ও সমৃদ্ধিতে থাকে, কিন্তু তা হলো না। কেন হলো না তা তোমার নিকট পত্রে কি লিখবো ? জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল অধঃপতিত লোকদের টেনে উপরে উঠানো। আমার জীবনে তা আর দেখে যেতে পারলাম না।”
ইতি-তোমার মামা
তথ্য সূত্র :
সৈয়দ নওশের আলীর জীবনী
সংগ্রহ :
হায়দার আকবর খান রণো
বিশিষ্ট বামপন্থি রাজনীতিবিদ
তথ্য সম্পাদনা :
মোঃ হাসানূজ্জামান (বিপুল)
সর্বশেষ আপডেট :
সেপ্টেম্বর ২০১১